বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, তবে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। শিক্ষকদের বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক অবস্থা, বাজেট বরাদ্দের অগ্রাধিকার, এবং শিক্ষাখাতে নীতিগত সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত। “অর্থনীতি এতই খারাপ যে শিক্ষকদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে”—এই মন্তব্যকে সরলীকৃত ধারণা বলা যায়। এটি বিশ্লেষণ করতে হলে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক এবং শিক্ষাখাতে বরাদ্দের প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে।

১. বাংলাদেশের অর্থনীতি: অগ্রগতি এবং সীমাবদ্ধতা

(ক) অগ্রগতির দিকhttps://amzn.to/3ZR4A7H

• মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি):
  বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, যার বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত কয়েক বছর ধরে ৬-৭% এর উপরে।
• রেমিট্যান্স ও রপ্তানি:
  রেমিট্যান্স এবং পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে।
• দারিদ্র্য হ্রাস:
  দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

(খ) সীমাবদ্ধতা

• বাজেট ঘাটতি:
  বাংলাদেশ এখনও বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন। আয় তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় শিক্ষাখাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ সম্ভব হয় না।
• বৈদেশিক ঋণ:
  দেশের বৈদেশিক ঋণের চাপ বেড়েছে, যা বাজেটের বড় অংশ গ্রাস করে।
• মূল্যস্ফীতি:
  সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে।

২. শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ

(ক) নিম্ন বাজেট বরাদ্দ

• ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে বাজেটের প্রায় ১২% বরাদ্দ দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যথেষ্ট কম। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী, শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের অন্তত ২০% বরাদ্দ হওয়া উচিত।
• শিক্ষাখাতে বাজেট কম থাকার কারণে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।

(খ) অগ্রাধিকার কম

• অন্যান্য খাত যেমন অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা, বা শিল্প খাতে তুলনামূলকভাবে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিক্ষাখাতকে যথাযথ অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না।

(গ) অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি

• বরাদ্দকৃত বাজেট অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ব্যয় করা হয় না।
• অর্থ ব্যয়ের অদক্ষতা এবং দুর্নীতির কারণে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রভাব পড়ে।

৩. শিক্ষকদের বেতন সংকট: কারণসমূহ

(ক) অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা নয়, বরং নীতিগত অবহেলা

• শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি বা সুযোগ-সুবিধা উন্নত করার বিষয়টি সরকারের নীতিগত অগ্রাধিকার তালিকার নিচে থাকে।
• অনেক উন্নয়নশীল দেশেও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকদের জন্য যথাযথ বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা হয়।

(খ) জনসংখ্যার চাপ

• বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে শিক্ষাখাতে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা বিশাল। এদের জন্য পর্যাপ্ত বেতন কাঠামো তৈরি করতে বড় আকারের বাজেট প্রয়োজন।

(গ) শিক্ষাখাতে বিনিয়োগের অভাব

• বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে বিনিয়োগ আন্তর্জাতিক গড় মানের তুলনায় অনেক কম।
• ফলে শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উন্নত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

(ঘ) রাজনৈতিক অগ্রাধিকার

• শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া প্রায়ই উপেক্ষিত হয়, কারণ এটি রাজনৈতিকভাবে অগ্রাধিকার পায় না।

৪. তুলনামূলক বিশ্লেষণ: উন্নত ও প্রতিবেশী দেশসমূহ

• উন্নত দেশগুলোতে:
  উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা উন্নত মানের, কারণ তারা শিক্ষাকে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হিসেবে দেখে।
• ভারত:
  ভারতের রাজ্যভেদে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ভিন্ন হলেও অনেক রাজ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের তুলনায় বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ভালো।
• শ্রীলঙ্কা ও নেপাল:
  বাংলাদেশের তুলনায় তাদের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কম, তবে শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা উন্নত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

৫. সম্ভাব্য সমাধান

(ক) শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি

• বাজেটে শিক্ষাখাতে অন্তত ২০% বরাদ্দ নিশ্চিত করা উচিত।
• শিক্ষকদের বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আলাদা বরাদ্দ নিশ্চিত করা।

(খ) নীতিগত পরিবর্তন

• শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধা বৃদ্ধি করা উচিত একটি কৌশলগত নীতি হিসেবে।
• শিক্ষকদের পেনশন সুবিধা এবং চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে।

(গ) বাজেট ব্যবস্থাপনার উন্নতি

• বরাদ্দকৃত বাজেটের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি রোধ করতে হবে।

(ঘ) জনসচেতনতা ও রাজনৈতিক চাপ

• শিক্ষকদের গুরুত্ব বুঝতে জনগণ এবং সরকারের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
• শিক্ষকদের দাবিগুলো রাজনৈতিক অগ্রাধিকার পেতে আন্দোলন এবং আলোচনার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।https://amzn.to/49Olbh7

উপসংহার

বাংলাদেশের অর্থনীতি হিমশিম খাচ্ছে না; বরং শিক্ষকদের বেতন সমস্যা মূলত শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ও নীতিগত অগ্রাধিকার সংকটের প্রতিফলন। যদি সরকার শিক্ষাকে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে এবং শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা উন্নত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে এটি শুধু শিক্ষকদের জীবনমান উন্নত করবে না, বরং দেশের সার্বিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।