শিক্ষকতা পেশার মহানুভবতা এবং এমপিওভুক্ত ব্যবস্থার অন্তরালে অন্তরীন সমস্যাগুলি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর বিষয়, যা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি এবং শিক্ষকদের প্রতি ন্যায্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি। শিক্ষকরা সমাজের ভবিষ্যৎ গঠনে অপরিসীম অবদান রাখেন, কিন্তু তাদের অধিকার, মর্যাদা এবং সুবিধা কিছু ক্ষেত্রে অবহেলিত থাকে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য এই অবস্থা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে, কারণ তারা অনেক সময় নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালন করলেও, তাদের জন্য সঠিক সম্মান, বেতন, সুযোগ এবং চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা হয় না।

১. শিক্ষকতা পেশার মহানুভবতা:
শিক্ষকরা শুধু জ্ঞান নয়, তারা শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস, জীবনমুখী শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ গঠন করেন। শিক্ষকতা পেশার মধ্যে রয়েছে একটি অত্যন্ত মহানুভবতা—যেখানে একজন শিক্ষক নিজের স্বার্থ ছাপিয়ে অন্যের উন্নতি এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। একজন শিক্ষক সমাজে ভবিষ্যতের নেতা তৈরি করেন, তাদের মধ্যে মুল্যবোধ এবং মানবিকতার শিক্ষা প্রদান করেন।

• শিক্ষকতা পেশায় নিজের উন্নতির চিন্তা কম থাকে, বরং অন্যের উন্নতির জন্য কাজ করা হয়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জীবনে এমন অবদান রাখেন যা নির্বিশেষে সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীদের মনোভাব, আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক মূল্যবোধ গঠন করা একটি অত্যন্ত মহান কাজ। তারা শিক্ষার্থীদের ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের উন্নতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

২. এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবস্থান:
এমপিওভুক্ত (MPO – Monthly Payment Order) শিক্ষকরা হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (যেমন কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা) এর শিক্ষকরা, যারা সরকারী বেতন স্কেলে বেতন পান, তবে এই বেতন তাদের সরকারি চাকরি নয়, বরং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা এবং সুবিধাসমূহ থাকে, তবে তাদের অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই অসন্তোষজনক।

ক) বেতন বৈষম্য:

• এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় অনেক কম। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এবং সরকারি সুবিধা অনেক বেশি। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন অনেক সময় অল্প হয় এবং তারা শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা না পাওয়ার কারণে হতাশ হন।
• এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি এবং বেতন বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আন্দোলন চলছে, কিন্তু এই সমস্যাগুলি এখনও সমাধান হয়নি।

খ) পদোন্নতির অভাব:

• এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির তুলনায় তাদের পেশাগত উন্নতি এবং পদোন্নতির সুযোগ কম থাকে। এমনকি দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষকতা করার পরও অনেক শিক্ষক পদোন্নতি পায় না। পদোন্নতি এবং কর্মস্থলে উন্নয়ন এর অভাব তাদের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ সৃষ্টি করে, যা তাদের কর্মদক্ষতা এবং মনোবলকে প্রভাবিত করে।

গ) চিকিৎসা সুবিধা:

• স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা চিকিৎসা সুবিধা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য প্রাপ্তি নয়। সরকারি চাকরিজীবীরা যেখানে সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা পান, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
• দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষকতা করার ফলে তাদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক চাপ তৈরি হয়, কিন্তু এই চাপের প্রতিকার হিসেবে কোনো সরকারি স্বাস্থ্যসেবা বা সুবিধা তাদের জন্য নিশ্চিত করা হয়নি।

ঘ) সামাজিক মর্যাদা:

• শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা সাধারণত অনেক বেশি থাকে, কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অনেক সময় অবহেলা করা হয়। তাদের কাজের মূল্যায়ন এবং সম্মান অনেক সময় অপ্রতুল থাকে।
• শিক্ষকরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, কিন্তু তারা তাদের আধিকার এবং সম্মান থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হন।

৩. এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মহানুভবতা:
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা তাদের পেশাগত দায়িত্বকে অত্যন্ত মহানুভবতার সঙ্গে পালন করেন, কিন্তু তাদের এই মহানুভবতার মূল্যায়ন যথাযথভাবে করা হয় না। তাদের কাজের প্রতি সম্মান এবং আধিকার না পাওয়ার কারণে, তাদের মধ্যে অহমিকা ও অনিচ্ছা তৈরি হতে পারে। যদিও শিক্ষকরা সমাজের জন্য অনেক কিছু দেন, তবে তাদের নিজস্ব জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেক সময় তাদের মানসিক চাপের সৃষ্টি করে।

৪. এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য দাবি:
বেতন বৃদ্ধি: এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন কাঠামোকে সরকারি শিক্ষকদের সাথে সমন্বয় করা প্রয়োজন।

• স্বাস্থ্য সুবিধা: তাদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্য সুবিধা বা বীমা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
• পদোন্নতি: নিয়মিত পদোন্নতি এবং উন্নত কর্মপরিবেশ তৈরি করা।
• শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি: শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা উন্নয়ন এবং তাদের প্রতি সম্মান বৃদ্ধি।

৫. উপসংহার:
শিক্ষকতা পেশার মহানুভবতা এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবস্থান একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। শিক্ষকরা তাদের মহানুভবতার মাধ্যমে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও, তাদের অধিকার, বেতন, স্বাস্থ্য সুবিধা, এবং মর্যাদা অনেক সময় অবহেলিত থাকে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য বেতন বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা, পদোন্নতি এবং সম্মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে তারা তাদের মহান দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন এবং তাদের পেশার প্রতি অনুপ্রাণিত থাকতে পারেন।