হাজারো আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি, সভা-সেমিনার, বিবৃতি আর চিঠিপত্রের পরও এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্দশা কাটে না! কবে হবে বেতন বৈষম্য দূর? কবে পেনশন পাবেন একজন প্রান্তিক মাদ্রাসা শিক্ষক? কবে চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা পাবেন সম্মানের সঙ্গে? এসব প্রশ্নে ঘুম ভাঙে রাষ্ট্রের বিবেকবান মানুষের। সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এক সাবেক শিক্ষানুরাগী বন্ধু ফোন করে বললেন, “দোস্ত, সেই তো শিক্ষকদের ‘নথ’ খসল না! তবে কেন আজীবন প্রতিশ্রুতির নাটক মঞ্চস্থ করিস?” বুঝলাম, তিনি ইঙ্গিত করছেন সেই চিরচেনা আশ্বাসের প্রতিশ্রুতি যা বছরের পর বছর ধরে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কান ঝালাপালা করে দিয়েছে, কিন্তু কোনো বাস্তব ফল দেয়নি।
আমাদের রাজনীতির বড় বৈশিষ্ট্য হলো — এখানে ‘শেষ কথা বলে কিছু নেই’, ঠিক যেমনটা ঘটে নির্বাচনী রাজনীতিতে, তেমনই ঘটে শিক্ষাখাতে। প্রতি বছরের বাজেট ঘোষণার আগে গণমাধ্যমে কিছু রোমাঞ্চকর খবরে চোখ যায় — ‘বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি সুবিধা দেওয়ার চিন্তা চলছে’, ‘সরকার বলেছে, এবার হবে সমাধান!’ — আর শিক্ষকেরা আশায় বুক বাঁধেন। তারপরে বাজেট আসে, প্রস্তাবনা আসে, কিন্তু বাস্তবতা থেকে যায় দূরে!
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা যেন সেই জাদুকরী কথাটির বাস্তব রূপ — ‘আছে, কিন্তু নেই’! রাষ্ট্র বলছে — “তোমরা রাষ্ট্রীয় খাত থেকে বেতন পাও, কিন্তু সরকারি কর্মচারী নও। তোমাদের জন্য কোনো পেনশন নয়, বাড়িভাড়া নয়, চিকিৎসা ভাতা নয়।” আবার একই সময়ে বলছে — “তোমরা শিক্ষা দিচ্ছ, তোমরা জাতি গড়ার কারিগর, তোমরা আমাদের উন্নয়নের চালিকাশক্তি।” একদিকে জাতি গঠনের দায়িত্ব, আরেকদিকে অবহেলা, বঞ্চনা — এ কেমন দ্বিচারিতা?
বেশ কিছু শিক্ষক সংগঠন বহু বছর ধরে একটাই দাবি করে আসছে — সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সমান সুযোগ-সুবিধা। প্রতিবারই সরকার আশ্বাস দেয় — “তোমাদের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।” আর শিক্ষকেরা প্রতিবারই বলেন — “এই তো এবার কিছু হবে!” কিন্তু বছর যায়, সরকার বদলায়, নেতা বদলায়, শুধু বদলায় না শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবনের বাস্তবতা।
কেউ কেউ বলছেন — “এটা সম্ভব নয়, কারণ বাজেটে এত বিশাল অর্থ বরাদ্দ দেওয়া কঠিন।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় উন্নয়ন প্রকল্পে, নানা দপ্তরের বিলাসী ভ্রমণে, অথচ জাতিগঠনের কারিগরদের ন্যায্য দাবিগুলো ‘অর্থ সংকট’ নামক অদৃশ্য দৈত্যের ভয়ে উপেক্ষিত থাকে কেন?
আর এই দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলন করলেই কিছু রাজনৈতিক লোক এসে গলার রগ ফুলিয়ে বলেন — “তোমরা তো শিক্ষার নামে আন্দোলন করছ, এটা তো সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র!” অথচ এই রাষ্ট্রের আদিগন্ত বিস্তৃত চিহ্নে শিক্ষকেরা আছেন বলেই আজ দেশের এই অগ্রগতি।
একজন বেসরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ৩৫ বছর শিক্ষকতা করার পর যখন চাকরি থেকে অবসর নেন, তখন তার হাতে থাকে না কোনো পেনশন, না থাকে প্রভিডেন্ট ফান্ড, না চিকিৎসা ভাতা। তার চোখের কোণে শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস — “আমি কি কিছু বেশি চেয়েছিলাম?”
এই রকম হাজার হাজার শিক্ষকেরা আজ সমাজে ছড়িয়ে আছেন — কেউ রিকশা চালান, কেউ দোকান খুলেছেন, কেউ সাহায্যের জন্য সন্তান বা আত্মীয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এটাই কি সেই রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র বলে — “শিক্ষকরাই জাতির বিবেক”? যদি বিবেক এভাবে অবহেলিত হয়, তাহলে বিবেকবান জাতি জন্মাবে কোথা থেকে?
যে সুশীল সমাজ মানবাধিকার, দুর্নীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন নিয়ে সদা সরব, তারাই এই শিক্ষক বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রায় নিশ্চুপ। কারণ হিসাবে যা বোঝা যায় আমাদের দেশের সুশীল সমাজ কোন শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। তারা মায়ের পেট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই পৃথিবীতে এসেছে। এদেশে যারা নিজেদের সুশীল হিসাবে পরিচয় দেয় তাদের সুশীলতা দেখলে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, সুশীলতা কাকে বলে। এদেশের সুশীল সমাজের কাজ দুর্বলের সমালোচনা করা আর সবলের চামচামী করা। এভবেই তারা তাদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত। তারা সকল সময় মনে করেন এদেশের একমাত্র জ্ঞানী তারা, তারাই এদেশের প্রকৃত নাগরিক, তারাই এদেশের একমাত্র ভাল চায়। তাদের মতে শিক্ষকেরা এই দেশের নাগরিক নন? তাদের মতে শিক্ষকের দিয়ে এদেশের কোন উপকার হয় বলে মনে হয় না। তারা মনে করেন যে, শিক্ষকেরা যে কাজ করে তার জন্য শিক্ষকদের কোন তেমন কোন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
আমি এখানে একটা কথা খুব জোর গলায় বলছি তা হলো এদেশের এখনও পেশাগত অবস্থানের দিক দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে সততার পরিমাণ অন্য যে কোন পেশার চেয়ে বেশি। হ্যাঁ বলবেন দলীয় লেজুরবৃত্তি তো শিক্ষকরাও করেন। করেন তবে তা উপর পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যে এই প্রভাব বেশি। যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সত্যি বলতে, অনেক শিক্ষক এখনো সরকার প্রধানের ওপর আস্থা রাখেন। কারণ তিনিই বহুবার বলেছেন, “আমি শিক্ষকদের সম্মান দিতে চাই।” কিন্তু সেই আস্থার বয়স বাড়ছে, বাস্তবতা বদলাচ্ছে না। এখন শিক্ষক সমাজ প্রশ্ন করছে — “সরকার প্রধানের এ ধরনের আশ্বাসে আর কতকাল, এই আশ্বাসে ভরসা রেখে বাঁচবো?
শিক্ষাকে আমরা বলি জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু সেই মেরুদণ্ডের ওপর যারা দাঁড়িয়ে আছেন, তারা যদি এমন অপমান, অনিশ্চয়তা, বঞ্চনায় থাকেন, তাহলে সে জাতির ভবিষ্যৎ কতটুকু দৃঢ় হতে পারে? আজ আমাদের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন — কথার ফুলঝুরি নয়, বাস্তব পদক্ষেপ। শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য পেনশন স্কিম চালু করা, পূর্ণাঙ্গ সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, এমপিও নীতিমালার সংস্কার করা — এই তিনটি পদক্ষেপ না নিলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত দুর্বল হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।
Leave a Reply