শিক্ষকদের বলা জাতির বিবেক, আর শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে এদেশের বা এ জাতির সরকারের বা নীতিনির্ধারকদের কোন কালেই মাথা ব্যাথা নেই। তাদের জীবন মান উন্নয়নে কোন পদক্ষেপে নেই। আমাদের দেশের সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা সকল সময় শিক্ষক বলতে চিনেন শুধু সরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের। যারা কিনা এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাত্র ৩-৪% অবদান রাখেন। আমি তাদের ছোট করার উদ্দেশ্য কিছু বলছি না। আমি শুধু এখানে পরিসংখ্যান তুলে ধরলাম। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ৯৭% অবদান কিন্তু এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অথচ তাদের ব্যাপারে সরকার সবসময় উদাসীন।
শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তা আগামীকাল, আগামী বছরের মধ্যে বা আরও বহু বছর পরেও অব্যাহত থাকবে। কারণ শিক্ষকরা শুধুমাত্র পাঠদানকারীই নন, তারা একজন সমাজ গড়ার কারিগর, যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দক্ষ, সচেতন ও মানবিক নাগরিক তৈরি করেন। তাদের অবদান চিরকালীন এবং সমাজের প্রত্যেক স্তরের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তার আশ্বাস আমরা পাচ্ছি তাদের নানা দিক থেকে গড়ে তোলা কর্মফল এবং সামাজিক সেবা থেকে।
শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তার আশ্বাস:
১. অধিকার ও শিক্ষার ভিত্তি গড়া:
শিক্ষকরা আগামী দিনগুলোতে প্রজন্মের অধিকার, ন্যায়বিচার এবং সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের ভূমিকা পালন করবেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য দূর করতে শিক্ষকদের কাজ চলবে। শিক্ষকরা সঠিক জ্ঞান এবং নৈতিকতা দিয়ে ছাত্রদের তৈরি করবেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে সমাজে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
২. আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলানো:
যতই প্রযুক্তি উন্নতি করুক, শিক্ষকদের গুরুত্ব কখনও কমবে না। ডিজিটাল শিক্ষা, অনলাইন লার্নিং, এআই টুলস ইত্যাদি শিক্ষার আধুনিক উপকরণ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকরা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য উপকারিতা পৌঁছাতে সাহায্য করবেন। তারা জানবেন কিভাবে একে শ্রেণীকক্ষে কার্যকরভাবে ব্যবহার করবেন এবং ছাত্রদের দক্ষতা বাড়াতে পারবেন।
৩. মানবিক মূল্যবোধের প্রচার:
আগামী প্রজন্মের মধ্যে সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সমাজসেবা গড়ে তুলতে শিক্ষকদের গুরুত্ব থাকবে। যেহেতু শিক্ষকরা ছাত্রদের মাঝে মূল্যবোধ গড়ার কাজ করেন, তারা মানবিকতার চর্চা এবং একটি নৈতিক সমাজ গঠনের জন্য প্রভাব ফেলবেন। এই ধরনের মূল্যবোধ পুরো সমাজে শান্তি ও সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটাবে।
৪. গবেষণা এবং চিন্তার বিকাশ:
শিক্ষকরা শুধু জ্ঞান প্রদানকারী নন, তারা গবেষকও। নতুন ধারণা, নতুন গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর মূল স্রষ্টা হিসেবে তাদের ভূমিকা অতুলনীয়। যত দিন যাবে, শিক্ষকদের গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন, চিন্তাভাবনা এবং সমাধানগুলোর উন্মোচন চলবে, যা সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
৫. অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষ:
শিক্ষকদের দিকনির্দেশনায় ছাত্ররা দক্ষ কর্মী, উদ্যোক্তা এবং নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগাতে সক্ষম নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে, যারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে অবদান রাখবে।
৬. বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক বিস্তার:
শিক্ষকরা শুধু নিজের দেশেই নয়, তারা আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতেও শিক্ষা ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখতে পারবেন। শিক্ষকদের সাহায্যে ছাত্ররা বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ভাষার সঙ্গে পরিচিত হবে, যা তাদের বিশ্বব্যাপী সম্পর্ক স্থাপন ও শ্রদ্ধাশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে।
৭. জীবন ও দক্ষতা শেখানো:
শিক্ষকরা জীবনযাত্রার দক্ষতা শিখিয়ে দিবেন, যেমন- সময় ব্যবস্থাপনা, আত্মবিশ্বাস, যোগাযোগ দক্ষতা, সামাজিক সম্পর্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন। ভবিষ্যতে পৃথিবীটাকে একটি ভালো জায়গা বানাতে শিক্ষকেরা মূল ভূমিকা পালন করবেন।
৮. চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা:
সমাজে নানা ধরনের পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে, তবে শিক্ষকেরা এই পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে ছাত্রদের প্রস্তুত করবেন যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে এবং দক্ষতার সাথে সেই পরিবর্তন মোকাবেলা করতে পারে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীরা যখনই কোন তাদের চাওয়া পাওয়ার কথা বলে তখনই বাজেটের ঘাটতি হয়ে যায়। তখনই অর্থনীতির দৈনদশার স্থিরচিত্র সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কিছু না চাইলে তখন দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়। তখন দেশ উন্নতির জোয়ারে ভেসে যায়। বিগত সরকার থেকে শুরু করে এ সরকারেরও নীতি নির্ধারক পর্যায়ে যারা কর্মরত আছেন তারা সকলেই এক জায়গায় একমত সেটা হল এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের কিভাবে ঠকানো যায়। বিগত সরকারের সময় আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করিয়ে পরক্ষণেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সাথে প্রতারণা করেছিল তৎকালীন সরকার।
এই সরকারের উপদেষ্টা মহোদয়রাও শিক্ষকদের ব্যাপারে উদাসীন। কিছু দিন পূর্বে একজন উপদেষ্টা শিক্ষদের উদ্দেশ্য করে বললেন যে, এ পেশায় না পোষালে অন্য পেশা খুঁজে নিতে। মাননীয় উপদেষ্টা আমাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে রাষ্ট্র যে বেতন আমাদের দেয় তা দিয়ে আমরা কোনকালেই স্বচ্ছল ভাবে সংসার চালাতে পারিনা এটা যেমন ঠিক। তেমনি ঠিক অমরা অস্বচ্ছল বলেই আপনাদের মতো লোকেরা আমাদের কে অন্যর্য কথা বলার সাহস করতে পারে। আমরা কিন্তু আমাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেই আমাদের এ পেশায় আসতে হয়েছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমরা দেখিনি আমাদের নাম শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হয়ে গেছে। আমরা অস্বচ্ছল হলেও আমাদের নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে দেই না।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা অনেকদিন থেকেই তাদের দাবী করে আসছে তাদের ন্যর্য অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। বিভিন্ন অফিসে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে, বিভিন্ন উপদেষ্টার নিকট তাদের আর্জিগুলো বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করেছে কিন্তু কেউ কোন প্রকার সুদৃষ্টি দেয়নি। বাধ্য হয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীরা আগামী ১২ ফেব্রুয়ারী থেকে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায়ের রাস্তা বের করেছে।
শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবী নিয়ে আন্দোলনের কথা অর্থ উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আবারও সেই পূর্বের সরকারের ন্যায় আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন যে দেখি আগামী বাজেটে কি করা যায়। মাননীয় উপদেষ্টা সকল পেশাজীবিদের দাবীগুলো তাৎক্ষণিক পূরণ করা হয় আর এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের দাবী পূরণ করতে আপনাদের বাজেট পর্যন্ত সময় লাগে।
পরিশেষে একটা কথায় বলব মাননীয় উপদেষ্টা আমরা আর আপনাদের মিষ্টি কথায় কান দিচ্ছি না আমাদের তাৎক্ষনিক যদি আমাদের দাবী পূরণের ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে করুন না আগামীর বাণী দিয়ে আমাদের সাথে ছলনার আশ্রয় নিবেন না দয়া করে। আমরাতো আপনাদের কথা ও পূর্বওয়লাদের কথার সাথে কোন অমিল পাচ্ছি না।
শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র আজকের দিনেই নয়, বরং আগামী কাল এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও অপরিহার্য। তারা সমাজের শিকড় থেকে শুরু করে, জাতির উন্নয়ন, শান্তি, এবং সমৃদ্ধির দিকে পথনির্দেশক। শিক্ষকদের পরিশ্রম এবং অবদান আমাদের আগামী পৃথিবীকে আরও সুনির্দিষ্ট, উন্নত এবং মানবিক করে গড়ে তুলবে। এজন্য, তাদের সম্মান, অধিকার ও সঠিক সুযোগের মাধ্যমে শিক্ষকদের মূল্যায়ন করা অপরিহার্য।
Leave a Reply