মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশাসনিক ব্যর্থতায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ থাকা–বিষয়টি বিশদভাবে, পরিষ্কার ভাষায় ও ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো:
দেশের চার লাখেরও বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী চলতি বছরের এপ্রিল মাসের বেতন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কেউ কেউ টানা দুই থেকে চার মাস ধরে কোনো বেতন পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম অর্থসঙ্কটে নিপতিত হয়েছেন এবং মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য সরাসরি দায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রশাসনিক অদক্ষতা ও প্রস্তুতির অভাব। দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত বেতন না পাওয়া শিক্ষকদের কাছে যেন এক স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অথচ এই সংকট নিরসনে মাউশির পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, তারা কবে বেতন পাবেন—তা জানতেও পারছেন না। অথচ সামনে ঈদুল আজহা। এ অবস্থায় মে মাসের বেতন ও উৎসব ভাতা পাওয়া নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। মাউশির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি। এমনকি মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খানও এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
শিক্ষকদের বেতন প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত মাউশির এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ইএমআইএস) সেল বর্তমানে কার্যত অচল। সেলের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট খন্দকার আজিজুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তার অনুপস্থিতিতে বেতন বিল প্রস্তুতের কাজ সম্পূর্ণ থেমে গেছে। বিস্ময়করভাবে, এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্য কোনো বিকল্প জনবল রাখা হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা আগে ড্যাশবোর্ডে যেসব তথ্য দেখতে পেতেন, এখন সেটিও প্রায় ফাঁকা। এতে শিক্ষকদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে—বড় ধরনের প্রশাসনিক সংকট কি ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে?
সরকার শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ডিজিটাল ও স্বচ্ছ করতে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। এর মাধ্যমে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি বেতন পাঠানোর কথা ছিল। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।
কিন্তু এপ্রিল মাসে এসে পুরো প্রক্রিয়া প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে।
অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর জাতীয় পরিচয়পত্র, এমপিও শিট ও ব্যাংকের তথ্যের সামান্য ভুল, যেমন—ডট, কমা, স্পেস, বানান ভুল, জন্মতারিখ বা শিক্ষাগত সনদের সঙ্গে অসামঞ্জস্যতা—এর ফলে ইএফটি সিস্টেম তাদের তথ্য গ্রহণ করছে না। ফলে এইসব শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন কয়েক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে।
যদিও অনেকে এসব তথ্য সংশোধন করে আবেদন জমা দিয়েছেন, মাউশির প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে এখনও তাদের বেতন ছাড় হয়নি।
যাদের তথ্য নির্ভুল, তারাও এপ্রিলের বেতন পাননি। অথচ সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতন পাচ্ছেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, ইএফটি চালুর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মাউশিকে প্রশিক্ষিত জনবল ও বিকল্প প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হতো। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, একজন কর্মকর্তার অসুস্থতার কারণে পুরো প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে।
দেশে প্রচুর দক্ষ আইটি বিশেষজ্ঞ থাকলেও তাদের সহায়তা নেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি মাউশি। শুধু ইএফটির কারণে নয়, শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় মাউশির অদক্ষতা বারবার প্রকাশ পাচ্ছে।
মাউশির ইএমআইএস সেলের প্রোগ্রামার মো. জহির উদ্দিন জানিয়েছেন, এখনো কাজ শেষ হয়নি তবে শিগগিরই হবে। অন্যদিকে কর্মকর্তারা বলেছেন, ইএমআইএস সেলের কাজ শেষ হওয়ার পর বেতন ছাড় হতে আরও চার-পাঁচ দিন লাগবে।
এতে ধরে নেওয়া যায়, এই সপ্তাহে কাজ শেষ না হলে এপ্রিলের বেতন মে মাসের শেষ সপ্তাহেও পেতে পারেন শিক্ষকরা।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে যে বেতন বৈষম্য, দেরি এবং অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছেন, সেটি এখন একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবস্থার অগ্রগতির যুগেও এই ধরনের সংকট মাউশির পরিকল্পনাহীনতা ও ব্যর্থতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
শিক্ষকরা এখন প্রশ্ন করছেন—“আমরা যদি দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর হই, তাহলে আমাদের কেন এমন অবহেলা?”
Leave a Reply