মেজর ডালিম ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তবে, তার বিপ্লবী পরিচয় মূলত তার অবদান ও অ্যাকশন এর মধ্যে নির্ধারিত হয়, এবং তার কর্মকাণ্ডের উপর বিতর্কও রয়েছে। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ড তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে। তবে তাকে তার কিছু বিতর্কিত কর্মকান্ড তাকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তেমনি তার অর্জন গুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার বিপ্লবী সত্তাকেও কলঙ্কিত করেনি কি?
মেজর ডালিমের ইতিহাস:
মেজর ডালিম, আব্দুল কাদের সিদ্দিকী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপ্লবী নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গেরিলা আক্রমণে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার নেতৃত্বে গঠিত ছিল গেরিলা বাহিনী, যা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফলভাবে আক্রমণ চালাতো।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ড:
মেজর ডালিমের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল:
1. পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ: মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। তার নেতৃত্বে গঠিত গেরিলা বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালাতো এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধকারী বাহিনী হিসেবে কাজ করেছিল।
2. পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ: মেজর ডালিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তার বাহিনী বিপ্লবী আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
3. মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ: মেজর ডালিম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তার নেতৃতে, তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ এবং বিপ্লবী কার্যক্রম চালিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শক্তিশালী করেছিলেন।
4. দেশের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে বিপ্লবঃ সে দেশের তৎকালীন শাসকদের বিরুদ্ধে তথা শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল যা তাকে তার বিপ্লবী সত্তার প্রকাশ হিসাবে চিনিয়ে দেয়।
মেজর ডালিম ছিলেন ১৯৭৫ সালের সেনা অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী।
বিপ্লবী হিসেবে বিতর্ক:
মেজর ডালিমের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড এবং তার অবদান সম্পর্কে কিছু বিতর্কও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, তার ভূমিকা এবং কিছু সিদ্ধান্তের কারণে তাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে, তার মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে অনেক আলোচনা রয়েছে:
1. 1975 সালের 15 আগষ্টের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার ঘটনায় তার বিপ্লবী সত্তা নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। কারণ বিপ্লবীরা কখনও নিরীহদের প্রতি দমন পিড়ীন চালায় না। বিপ্লবীরা যা করে জনসম্মুখে করে ঘোষনা দিয়ে সে কাজ সম্পন্ন করে। আমরা অনেকে যতই তাকে ইতিহাসের বিপ্লবী নায়ক হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করিনা কেন সে কখনও সে নায়কের স্থান অনেকের হৃদয়ে পাবে বলে মনে হয় না।
2. ১৯৭৫ সালের পরবর্তী ঘটনাবলী: ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিপ্লব এবং জিয়াউর রহমানের উত্থান এর সময় মেজর ডালিমের ভূমিকা ছিল। অনেকেই তাকে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিপ্লবী অবতার হিসেবে দেখেন, তবে তার কার্যক্রমের কিছু দিক নিয়ে অনেকের মধ্যেই অসন্তোষ ছিল।
3. সামরিক শাসন: মেজর ডালিমের কিছু কর্মকাণ্ড পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে গেছে, যা অনেকের কাছে প্রতিবাদী ছিল। অনেকেই মনে করেন যে, তার কিছু সিদ্ধান্ত স্বাধীনতার আদর্শের বিরুদ্ধে ছিল, বিশেষ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর, তিনি সরকারি শাসনের মধ্যে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইন্ধন দিয়েছেন।
এখন আমরা একটু দেখার চেষ্টা করি আসলে বিপ্লবী কাদের বলা হয়। তাদের সাথে কি মেজর ডালিমের চরিত্রে মিল পাওয়া যায় কিনা?
বিপ্লবী হলো এমন ব্যক্তি, যিনি সমাজ, রাষ্ট্র, বা শাসনব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন এবং প্রায়ই প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নতুন ধারণা, নীতি, বা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে চান।
বিপ্লবী শব্দটি এসেছে “বিপ্লব” থেকে, যা একটি সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী বা নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি হলেন বিপ্লবী।
বিপ্লবী কেবল একটি আন্দোলনের নেতা নন; তিনি একাধারে চিন্তাবিদ, সংগ্রামী, এবং ভবিষ্যতের নির্মাতা। তাদের আদর্শ, সাহস, এবং কর্মকাণ্ড সমাজকে নতুন পথে পরিচালিত করে এবং মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। বিপ্লবীরা ইতিহাসের অংশ হয়ে সমাজকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যান।
এখন আমরা একটু আলোচনা করব বিপথগামী কি সেটা নিয়ে?
বিপথগামী শব্দের অর্থ হলো, যে ব্যক্তি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভুল পথে চলে বা নৈতিক, সামাজিক বা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য পথ থেকে সরে যায়। এটি এমন কাউকে বোঝায়, যার কাজ, আচরণ, বা জীবনযাত্রা সঠিক মানদণ্ডের বাইরে চলে গেছে।
বিপথগামী ব্যক্তি নিজের এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তবে সঠিক দিকনির্দেশনা, শিক্ষা, এবং মানসিক সহায়তার মাধ্যমে তাদের পুনরায় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য পরিবার, সমাজ, এবং সরকারের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার:
মেজর ডালিম, বা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বিপ্লবী ছিলেন, তবে তার বিপ্লবী পরিচয় এবং তার কর্মকাণ্ড বিভিন্ন পর্যায়ে বিতর্কিত হয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর নেতা ছিলেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তার পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিতর্কিত কিছু সিদ্ধান্তের কারণে তাকে নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তাই, তাকে বিপ্লবী হিসেবে শ্রদ্ধা করা হলেও, তার কর্মকাণ্ডের কিছু দিক নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক রয়েছে। পরিশেষে একথা বলা যায় যে, সকল কিছু অলোচনা শেষে ইতিহাসই একদিন ঠিক করবে কে বিপ্লবী আর কে বিপথগামী।
Leave a Reply