বাংলার বিভক্তি ও তার পেছনের কারণগুলো বিশদে ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষণ করতে হবে।
প্রথম বিভাজন: ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ
বঙ্গভঙ্গ ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে প্রথমবারের মতো বাংলা প্রদেশকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
প্রেক্ষাপট ও কারণ
- প্রশাসনিক জটিলতা:
- ব্রিটিশ ভারতীয় শাসনে বাংলা ছিল সবচেয়ে জনবহুল এবং ভৌগোলিকভাবে বড় প্রদেশ।
- এই বিশাল প্রদেশ শাসন করা ব্রিটিশদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।
- ব্রিটিশ সরকার দাবি করে, প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলাকে ভাগ করা জরুরি।
- ব্রিটিশ কৌশল – “Divide and Rule”:
- ব্রিটিশরা জানত, হিন্দু-মুসলিম একত্রে আন্দোলন করলে তাদের শাসন টেকানো কঠিন হবে। তাই তারা ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়াতে চেয়েছিল।
- পূর্ব বাংলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি ছিল, যেখানে পশ্চিম বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশরা এই ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করেছিল।
- অর্থনৈতিক কারণে বিভাজন:
- পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ ছিল। ঢাকাকে প্রশাসনিক কেন্দ্র করে একটি আলাদা প্রদেশ গঠন করলে, ব্রিটিশরা দাবি করে, পূর্ব বাংলার উন্নয়ন দ্রুত হবে।
ফলাফল
- বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলা দুই ভাগে ভাগ হয়:
- পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ (ঢাকা রাজধানী) – মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল।
- পশ্চিম বাংলা (কলকাতা রাজধানী) – হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল।
- এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। কারণ:
- কলকাতার বণিক সমাজ বঙ্গভঙ্গের ফলে ব্যবসায়িক সুবিধা হারানোর আশঙ্কা করে।
- বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় এটি তাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হিসেবে দেখে।
- বিপুল আন্দোলনের ফলে বঙ্গভঙ্গ ১৯১১ সালে বাতিল করা হয়।
দ্বিতীয় বিভাজন: ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি
প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর মধ্যে বাংলা পুনরায় বিভক্ত হয়ে পশ্চিম বাংলা ভারতের অংশ এবং পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের অংশ হয়।
কারণসমূহ
- ধর্মীয় বিভাজন:
- ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ “লাহোর প্রস্তাব”-এ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের দাবি তোলে।
- ধর্মকে ভিত্তি করে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
- রাজনৈতিক চাপ:
- মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে মতবিরোধ।
- ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য দ্রুত সমাধানের পথে হাঁটে এবং দ্বিজাতি তত্ত্ব (Two-Nation Theory) মেনে নেয়।
- র্যাডক্লিফ লাইন ও সীমান্ত নির্ধারণ:
- স্যার সাইরিল র্যাডক্লিফ সীমান্ত নির্ধারণের দায়িত্ব পান।
- বাংলার বিভাজন হিন্দু-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
- পশ্চিম বাংলা ভারতের অংশ হয়, আর পূর্ব বাংলা হয় পাকিস্তানের পূর্ব অংশ।
বিভক্তির প্রভাব
- ধর্মীয় সংকট:
- বিভাজন মূলত ধর্মের ভিত্তিতে হওয়ায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ বেড়ে যায়।
- অনেক মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়, যা ব্যাপক সহিংসতার সৃষ্টি করে।
- সাংস্কৃতিক বিভাজন:
- একই ভাষা-বর্ণ-সংস্কৃতির লোক হলেও, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক সীমারেখা তৈরি হয়।
- পশ্চিম বাংলা ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে ওঠে, যেখানে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের শাসনে মুসলিম সাংস্কৃতির দিকে ধাবিত হয়।
- বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা:
- পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে।
- এর পরিণতিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা বাংলাদেশ হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠে।
দুই বাংলার বিভাজনের প্রভাব – আজকের প্রেক্ষাপটে
- রাজনৈতিক প্রভাব:
- পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ দুটি স্বাধীন প্রশাসনিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অংশ।
- দুটি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল হলেও তাদের অভিন্ন প্রশাসনিক লক্ষ্য নেই।
- সাংস্কৃতিক সংযোগ ও পার্থক্য:
- দুই বাংলার সাহিত্য, সঙ্গীত, এবং ঐতিহ্যের মধ্যে অনেক মিল থাকলেও, পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে দুই পক্ষের নিজস্ব রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রবাহ তৈরি হয়েছে।
- অর্থনৈতিক প্রভাব:
- বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছে, যেখানে পশ্চিম বাংলা ভারতের বৃহত্তর অর্থনীতির অংশ।
উপসংহার
বাংলার বিভাজন ছিল একদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতির কূটকৌশল এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। বিভাজন কেবল একটি ভৌগোলিক ভাগ নয়, বরং এটি ছিল মানুষের জীবনে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মানসিক এক বিশাল পরিবর্তন। তবে ভাষা এবং সংস্কৃতি এখনও দুই বাংলাকে ঐতিহ্যের এক অভিন্ন সুতায় বেঁধে রেখেছে।
Post Views: 67
Leave a Reply