বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক ও কর্মচারী রাষ্ট্রীয় এমপিও সুবিধার আওতায় বেতন ভাতা পেলেও, তাদের ন্যায্য অধিকার ও দাবিগুলো বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। এর পেছনে অন্যতম বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অযোগ্যতা। সংগঠনের অভ্যন্তরে নীতি-আদর্শভিত্তিক নেতৃত্বের অভাব, দাবি আদায়ে পরিকল্পনাহীনতা এবং কার্যকর কৌশলের ঘাটতির কারণে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলো কখনোই জোরালোভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।
নেতৃত্বহীনতা বলতে এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায়, যেখানে কোনও দল, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা সমাজে সঠিক ও কার্যকর নেতৃত্বের অনুপস্থিতি দেখা দেয়। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দিকনির্দেশনা, সমস্যা সমাধান এবং অগ্রগতির ক্ষেত্রে স্থবিরতা বা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
অযোগ্য নেতৃত্ব বলতে এমন কোনো নেতাকে বোঝায়, যার মধ্যে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলি, দক্ষতা, দূরদৃষ্টি, নৈতিকতা বা সমস্যার সমাধান করার সামর্থ্য নেই। এ ধরনের নেতৃত্ব ব্যক্তির, প্রতিষ্ঠানের বা জাতির অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
স্বার্থান্ধতা বলতে বোঝায় এমন একটি মানসিকতা বা আচরণ, যেখানে ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ বা লাভকে গুরুত্ব দেয় এবং অন্যের প্রয়োজন, অধিকার বা মঙ্গলের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন বা অন্ধ হয়ে পড়ে।
প্রতিবারই যখন নতুন কোনো সরকারি সুবিধা আসে—যেমন প্রণোদনা, উৎসব ভাতা, ইনক্রিমেন্ট বা বিভিন্ন সুবিধা প্রাপ্তির সময় আসে—তখনই এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা তাদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে সংগঠনগুলোর একতাবদ্ধ ও দৃশ্যমান অবস্থান না থাকায় সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেক সময় শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দাবিগুলো যে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না, সে বিষয়েও অভিযোগ রয়েছে। ফলে সরকারি সিদ্ধান্ত প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবে কতদিন চলবে? এভাবে কতদিন ভিক্ষার থালা হাতে অপেক্ষা করতে হবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের প্রাপ্তির খাতায় নিজেদের পাওনা আদায়ের জন্য।
তারপর সরকার যখন দেখে যে, এত ঝামেলা থেকে অথবা ভাবে এদেরকে দেওয়া যায় তাই দেওয়া হোক তখন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য ঘোষণা দেওয়া হয় বা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই যে, এবারই যখন সরকারী চাকুরীজীবিদের জন্য যখন বিশেষ আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির প্রজ্ঞাপন জারি করা হল তখন যদি ঐখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের কথা যুক্ত করা হতো তাহলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত, সেই তো প্রজ্ঞাপন হলো তাহলে কেন প্রথমে হলো না। এর জন্য দাীয় কে, এই খামখেয়ালী সিদ্ধান্ত কারা গ্রহণ করল। সবচেয়ে বিষ্ময়ের জন্ম দিল আমাদের কিছু কিছু সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এর জন্য আবার সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে। ভুল করল সরকার সেই ভুলের সংশোধন করার জন্য যদি ধন্যবাদ পাওয়া যায় তাহলে তো এই ভুল বার বার করবে। এই যদি নেতৃত্বের নমুনা হয় তাহলে এই নেতৃত্বকে আপনি কোন ধরনের নেতৃত্ব বলবেন। প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, প্র্রিয় নেতৃবৃন্দ একই ভুল যদি বার বার হয় তখন কিন্তু তাকে আর ভুল বলা যায় না তখন সেটা অন্যায় হয়ে যায়। আর সেটা সংশোধনের করার জন্য যদি কাউকে ধন্যবাদ দিতে হয় না কারণ সংশোধনের জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য হয় তাহলে কিন্তু তা পুনরায় আবার ফিরে ফিরে আসবে। আর অন্যায়কে যদি অন্যায় বলার সাহস না পান তাহলে আপনাদের নেতৃত্ব নিয়েই কিন্তু প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আর নেতৃত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠবে তখন আপনি বা আপনারা যখন দাবী আদায়ে ডাক দিবেন তখন আপনাদের পক্ষে লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অধিকাংশ দাবি যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবভিত্তিক। কিন্তু নেতৃত্বের দূরদর্শিতা না থাকায় এসব দাবির বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায়। বিশেষ করে তথ্যভিত্তিক প্রচারণা, গণমাধ্যমে আলোচনার সৃষ্টি, সংসদীয় কমিটি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রভাব বিস্তারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন অধিকাংশ নেতৃত্ব। ফলাফল—সংগঠনগুলো আস্থা হারাচ্ছে, আর শিক্ষকেরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকছেন তাদের দাবি আদায় নিয়ে। অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে একত্রিত হতে বললে শিক্ষকরা বুঝতে পারেনা কে সত্যিকারের অধিকার আদায়ের জন্য ডাকছে আর কে বা তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ডাকছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষক সংগঠনগুলোতে অবসর প্রাপ্তদের ছড়াছড়ি কারণ এখানে রয়েছে অবসর ও কল্যাণ তহবিল নামক টাকা কামানোর একটা তহবিল। কোনভাবে দলীয় লেজুরবৃত্তি করে যদি এই তহবিলের সদস্য হওয়া যায় তাহলে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার একটা সুযোগ থাকে। আর এই কারণে অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকরাও হাসপাতালের বেড থেকে উঠে চলে যান মিটিং করতে যদি ঐ বোর্ডের সদস্য বাগিয়ে নেওয়া যায়।
এই সংকট উত্তরণের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো কার্যকর, স্বচ্ছ ও অরাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা। নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের উচিত কেবল পদ আঁকড়ে না থেকে শিক্ষকদের জন্য বাস্তবিক কাজ করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে দাবিগুলোকে স্থান দেওয়ার কৌশল রপ্ত করা। প্রয়োজন হলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষকদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে, যারা আধুনিক কৌশল, আইনি প্রক্রিয়া এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষ। কিন্তু এখানেই আমাদের অনেক সমস্যা পুরাতনরাই বিভিন্ন অজুহাতে ক্ষমতা ছাড়তে চায়না এমনিক অবসরের পরও তারা তাদের নেতৃত্ব আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।
যোগ্য নেতৃত্বের অনুপস্থিতি শুধু শিক্ষকদের ক্ষতি করছে না, এতে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিক্ষক সমাজ যদি নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় সংগঠিত ও দক্ষ না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরো বড় সংকটের মুখে পড়তে হবে। তাই এখনই সময় নিজেদের নেতৃত্ব ও সংগঠন নিয়ে নতুন করে ভাবার এবং সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব গড়ে তোলার। তবেই হয়তো এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার অর্জন করতে পারবেন।
যোগ্য নেতৃত্বের বড়ই অভাব এই পেশায়, শুধু যোগ্য, সৎ ও নির্ভীক নেতা যদি আজ আমাদের থাকত তাহলে আজ আমাদের অধিকার আদায়ে দিনের পর দিন সরকার বা আমলাদের কাছে ধরণা দিতে হতো না। তারাই আমাদের বলত যে, আপনাদের এই সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করছি আপনারা বিনিময়ে এদেশের জন্য কি প্রতিদান দিতে পারবেন।
Leave a Reply