১. প্রথম যুদ্ধ (১৯৪৭-১৯৪৮) — কাশ্মীর যুদ্ধ
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয়। জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা প্রথমে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানপন্থী উপজাতিরা আক্রমণ করলে তিনি ভারতের সাথে যুক্ত হতে সম্মত হন। ভারত কাশ্মীরে সৈন্য পাঠায়। যুদ্ধের শেষে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয় এবং কাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত হয় (বর্তমান ভারত-শাসিত জম্মু-কাশ্মীর ও পাকিস্তান-শাসিত আজাদ কাশ্মীর)।
২. দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৯৬৫) — কাশ্মীর কেন্দ্রিক পুনরায় সংঘর্ষ
পাকিস্তান ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ চালু করে কাশ্মীরে বিদ্রোহ উস্কে দেয়ার চেষ্টা করে। ভারত তা প্রতিরোধ করে এবং পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ প্রধানত কাশ্মীর এবং পাঞ্জাব অঞ্চলে সংঘটিত হয়।শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয়। পরে ১৯৬৬ সালে তাশখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খান)।
৩. তৃতীয় যুদ্ধ (১৯৭১) — বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধীনতার দাবির কারণে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সামরিক সহায়তা দেয়। পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারতের উপর হামলা করে, ফলে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর জয় হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
৪. চতুর্থ সংঘর্ষ (১৯৯৯) — কারগিল যুদ্ধ
পাকিস্তানের সেনা ও মিলিশিয়া বাহিনী কারগিল সেক্টরে অনুপ্রবেশ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী দখলকৃত এলাকা পুনরুদ্ধারে অভিযান চালায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান পিছু হটে।
৫. ভারত-পাকিস্তান বর্তমান সমস্যা(২০২৫) সম্ভাব্য যুদ্ধ
ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের পেহেলগামে হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ চলছে। পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা স্পষ্ট হচ্ছে সাম্প্রতিক সংবাদ শিরোনামগুলোতে—যেমন, “ভারত যদি জল বন্ধ করে, তা যুদ্ধের শামিল হবে”, “হামলার পরিকল্পনাকারীদের কল্পনাতীত শাস্তি হবে”, অথবা “প্রত্যেক নাগরিকের মৃত্যুর বদলা নেবে পাকিস্তান”।
২২ এপ্রিল পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন পর্যটক। এই হামলার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। ভারত সীমান্তে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বা ‘সমুচিত জবাব’ দেওয়ার কথা বলছে, আবার পাকিস্তানও পাল্টা জবাবের হুমকি দিচ্ছে।
উরি এবং পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারতের প্রতিক্রিয়া মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রশ্ন—এই উত্তেজনা কি আরেকটি বড় সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে? পুলওয়ামার পর যেমন ভারত বালাকোটে বিমান হামলা চালিয়েছিল এবং পাকিস্তান ভারতীয় পাইলট আটক করেছিল, সেই স্মৃতি এখন আবার সামনে আসছে।
পেহেলগামের ঘটনার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দোষারোপ না করলেও সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত, সীমান্ত ক্রসিং বন্ধসহ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতের দাবি, হামলাকারীদের মধ্যে দু’জন পাকিস্তানি নাগরিক রয়েছে।
ভারতের কঠোর পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তানও সিমলা চুক্তি স্থগিত, সীমান্ত ও বাণিজ্য বন্ধ, এবং ভারতের বিমানের জন্য আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সিন্ধু নদীর জল প্রবাহ বন্ধ করলে তা সরাসরি যুদ্ধের কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পানির মতো মৌলিক সম্পদ ব্যবহার করে চাপ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত বর্তমান উত্তেজনাকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে।
পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, পরিস্থিতি এখন আর মধ্যম পর্যায়ের উত্তেজনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাবেক মার্কিন কূটনীতিক এলিজাবেথ থারলকেল্ড মনে করেন, সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা থাকলেও তা কখন এবং কীভাবে হবে তা অনিশ্চিত।
অন্যদিকে, অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কেউ কেউ মনে করছেন, ভারত-পাকিস্তান আবার সরাসরি যুদ্ধের দিকে না গিয়ে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে। যেমন, মুশাহিদ হুসেন সৈয়দ মনে করেন, ভারত এখন সামরিক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে পারে, কারণ অতীতে এর নেতিবাচক কূটনৈতিক প্রভাব পড়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তান নিজেরাই সমাধান খুঁজে নেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সীমিত এবং মধ্যস্থতা করার সম্ভাবনাও কম।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পানির বিষয়টিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা দেখায়, দুই দেশ অনেকবার যুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ এড়িয়ে গেছে।
বিশ্লেষক অ্যাডাম ওয়েনস্টেইনের মতে, দুই দেশ যদি উত্তেজনায় আবর্তিত হয়, তবে তারা জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য বা আঞ্চলিক সহযোগিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকেও মনোযোগ দিতে পারবে না।
সংক্ষেপে কিছু মূল পয়েন্ট:
প্রধান কারণ: কাশ্মীর ও আঞ্চলিক আধিপত্য নিয়ে বিরোধ।
প্রধান ফলাফল: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল।
বর্তমান অবস্থা: দুই দেশের মধ্যে এখনও উত্তেজনা রয়েছে, বিশেষ করে কাশ্মীর প্রশ্নে। উভয় দেশের মধ্যে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
Leave a Reply