ভূমিকা:
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড—এই প্রবাদটি আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। কিন্তু যখন সেই মেরুদণ্ড রক্ষাকারী শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, তখন প্রশ্ন ওঠে—আমরা কি সত্যিই শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছি? বা দিলেও কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের দেশের সরকার ও আমলারা মুখে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রদানের কাজে নিয়োজিত শিক্ষকদের নিয়ে খুব ভাল ভাল কথা বললেও বাস্তবে বা নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার ছিটেফোটাও দেখা যায় না।
বর্তমানে বাংলাদেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ যেভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত, তা কেবল একটি শ্রেণির সমস্যা নয়, বরং এটি পুরো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই হুমকি। কারণ এদেশের মাধ্যমিক লেভেলের শিক্ষা আপনি শিকার করেন আর না করেন অনেককাংশে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এখানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব:
- প্রধান শিক্ষাগত কাঠামো: দেশের সর্বত্র বিরাজমান এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজগুলো দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি। এখানে পাঠদান যারা করেন তারাই মুলতঃ এদেশের প্রকৃত মালিক। কারণ এখানেই এদেশের কমবেশি ৯৭% শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। বাঁকি যে ৩% তারাও এদের শোষণ করে শোষিত করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করে সমাজের উচু এলাকায় বাসস্থান তৈরী করে আভিজাত্য তৈরী করে। এমপিওভুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা পিছিয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল এদেশের আমলাদের কিছু অনৈতিক নীতি ও তার নগ্ন বাস্তবায়নের কৌশল।
- দশকের পর দশক ধরে অবদান: শহর থেকে গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাহাড়ি এলাকায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা তাদের সীমিত উপার্জনে শিক্ষা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এদেশে মাধ্যমিক লেভেলের সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৩৩টি। এই পরিমাণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে দেশের শিক্ষার চাহিদার কি পরিমাণ পুরণ করা সম্ভব। তাই এদেশের শিক্ষার চাহিদা পুরণ করতে হলে যে মাধ্যমটি সবচেয়ে বেশি ভুমিকা পালন করে আসছে আজ তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। শুধু অববেহিলিত বললে ভুল হবে আজ তারা দিন নিংশোষিত হতে হতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনি গাছ থেকে শুধু ফল আশা করলে তো হবে গাছকেও তো পুষ্টির যোগান দিতে হবে। ভাল সুমিষ্ট ফল পেতে হলে তার জন্য সেই গাছকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের সরবরাহ তো করতে হবে।
- বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে বাংলাদেশে মোট ৬৫৩টি সরকারি কলেজ আছে। যার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৩৭টি, চট্টগ্রাম ১২৫টি, রাজশাহী বিভাগে ৯০টি, খুলনায় ৮৭টি, রংপুর বিভাগে ৭৪টি, বরিশাল বিভাগে ৫৩টি, সিলেট বিভাগে ৪৪টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪২টি সরকারি কলেজ রয়েছে। এই পরিমাণ উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান দিয়ে আপনি একটি দেশের মোট শিক্ষা ব্যবস্থার কতটুকু চাহিদা পুরণ করতে পারবেন।
এখানে কর্মরত শিক্ষকরা/এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কীভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন?
- অনিয়মিত বেতন ও ভাতা: সরকারি ভাবে প্রাপ্ত এই শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ যে বেতন বা অনুদান তাদের মাস শেষে প্রদান করা হয় তার প্রদানের নিয়মনীতি এমন যে শিক্ষকরা মাস শেষ হলে জানেন না কখন তারা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বেতন বা অনুদান পাবেন। এবং এই অবস্থা আজ এক মাস বা দুই মাসের জন্য এমন নয় এই রীতি চলে আসতেছে এই ব্যবস্থার শুরু থেকে। আর এই কারসাজীর পিছনে সরকারের যতটুকু না অবহেলা রয়েছে তার চেয়ে বেশি রয়েছে এদেশের সরকারের আমলাতন্ত্রের গোপন কারসাজি।
- ইএফটি (EFT) পদ্ধতিতে জটিলতা: ডিজিটাল পদ্ধতির নামে বেতন প্রদানে নানা হয়রানি ও বিলম্ব। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন প্রদানের হয়রানি ও জটিলতা দুরীকরণের জন্য সরকার ঘোষণা দেয় যে, ২০২৫সালের জানুয়ারী মাস হতে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের পর্যায়ক্রমে ইএফটির মাধ্যমে বেতন প্রদান করা হবে। কিন্তু এখানেও আমলাদের কালো হাতের থাবা মুক্ত হতে পারেনি। এই ইএফটির বাস্তাবায়ন করতে গিয়ে আমলাদের নানামুখী জটিলতার মাধ্যমে শিক্ষকদের হয়রানি ও বেতন আটকে রাখা হয়েছে যা এখনও চলমান রয়েছে। কারণ হিসাবে অফিসিয়ালী কিছু না বললেও গোপন সুত্রে যা জানা গিয়েছে তা হলো মাউশির সুদ বাণিজ্যের খবর। মাউশি কখনও চায় না যে, এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের ইএফটি সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন হউক।
- উৎসব ভাতা ও অন্যান্য সুবিধায় বৈষম্য: সরকারি কর্মচারীরা যখন উৎসবে পরিবার নিয়ে আনন্দ করেন, তখন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কষ্টে সংসার চালান। একই দেশে বসবাস করে একই সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে একজন সরকারী শিক্ষক যেখানে উৎসব ভাতা পায় ১০০% সেখানে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক পান মাত্র ২৫% তাও আবার তারা তা পান উৎসব গত হওয়ার পর।
- প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা: মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। মাউশি কখনও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কোন সিদ্ধান্ত আজ পর্যন্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে নিতে পারেনি। মাউশি সকল সময় সকল সিদ্ধান্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত। যেমনঃ শিক্ষকদের বেতনের টাকা কর্তনের সিদ্ধান্ত অবৈধ ও জোর করে এখন অবধি ৬% এর স্থলে ১০% করে নিচ্ছে। এ বিষয়ে কোর্টের সুনির্দিষ্ট রায় থাকার পরও এ সমস্যার কোন প্রতিকার পাওয়া যায় নি।
কেন এই সমস্যা সমাধান জরুরি?
- শিক্ষার মান রক্ষায়: হতাশাগ্রস্ত শিক্ষক কখনোই শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারেন না। আপনি কখনও আজীবন জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে কোন পেশাজীবিদের দাবিয়ে রাখতে পারবেন না। কখনও না কখনও এর বিষ্ফোরণ ঘটবেই। তাই সময় থাকতে এর সঠিক সমাধানের দিকে যাওয়াই বুদ্ধিমানের পরিচয়।
- জাতি গঠনে ব্যাঘাত: অবহেলিত শিক্ষক মানেই দুর্বল জাতি গঠন। আপনি শিক্ষকদের ফাঁকি দিয়ে ফাঁকিবাজ জাতি গঠন করতে যদি চান তাহলে কিছু করারও নাই বলার ও নাই। বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
- যথাযথ স্বীকৃতি: এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ছায়া যোদ্ধা, তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। কাউকে যখন তার প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করবে দিনের পর দিন সে কিন্তু কোন একদিন বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। আর একজন বিদ্রোহী কিন্তু একটি আগুনোর লেলিহান শিক্ষা। সামান্য আগুনের শিখা কিন্তু অনেক কিছুই করতে পারে।
সরকারের প্রতি অনুরোধ:
- বেতন-ভাতা নির্ধারিত সময় অনুযায়ী প্রদান নিশ্চিত করুন। একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। প্রতি মাসের ১ তারিখ না দিতে পারেন ৫ তারিখে প্রদান করুন কিন্তু তা যেন প্রতিমাসেই বহাল থাকে।
- উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাগুলো সরকারি শিক্ষকদের সমতুল্য করুন এবং তা সময় মত প্রদান করুন।
- ইএফটি পদ্ধতির জটিলতা দূর করে একটি সহজ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করুন ও ভুল বুঝিয়ে ভুল কারণ দেখিয়ে কতদিন এভাবে শিক্ষকদের কষ্ট দিবেন তা না করে সঠিকতার সন্ধান করুন।
- শিক্ষকদের নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষকদের প্রতিনিধিদের যুক্ত করুন। দলবাজ ও দলকানা শিক্ষক নেতাদের বয়কট করে যারা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকদের ধারক ও বাহক তাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত করুন।
- এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এদেশের একজন সৈনিক মনে করুন তারা দেশের জন্য একজন সৈনিকের চেয়ে কোন অংশে কম অবদান রাখে না। তাদেরকে অযথা প্রতিপক্ষ বা তাদের অনৈতিক ভাবে ব্যবহার বন্ধ করুন।
শিক্ষক সমাজের করণীয়:
- ঐক্যবদ্ধ হয়ে ন্যায্য দাবির জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলুন। দলীয় লেজুরবৃত্তি পরিহার করুন।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করুন। প্রচারেই প্রসার তাই নিজেদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বিভিন্নমুখি প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
- শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আন্দোলন গঠনমূলক রাখুন। সরকারকে যেভাবে বুঝালে আমাদের চাওয়া এবং পাওয়াগুলো সরকারের নিকট যুক্তিযুক্ত মনে হয় সেই পন্থা অবলম্বন করুন।
- অযথা নাম ও দল সর্বস্ব সংগঠনকে পরিহার করুন। নৈতিকতা সমৃদ্ধ সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে দাবি আদায়ে সচেষ্ট থাকুন। সাংগাঠনিক শক্তি আপনার বা আপনাদের দাবি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা শুধু বেতন নেন না, তারা ভবিষ্যৎ গড়ে দেন। তাদের প্রতি অবহেলা মানে জাতির ভবিষ্যতের প্রতি অবহেলা। তাই আসুন—সবার সম্মিলিত প্রয়াসে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সুবিধা ফিরিয়ে দিই। এদেশকে সঠিক ও সমৃদ্ধশালী করতে হলে অবশ্যই আপনাকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে এর কোন বিকল্প নাই। তেমনি শিক্ষাকে যদি আপনি সার্বজনীন করতে চান সকলকে যদি শিক্ষার আওতায় আনতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা তথা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতি নজর দেওয়া অধিকতর গুরুত্ব বহন করে।
Post Views: 228
[…] আরও পড়ুন…..এদেশের শিক্ষা বাঁচাতে হলে এমপিওভুক্ত… […]