১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হয়। কিন্তু অনেকের মতে, এই ঐতিহাসিক দিনটির সুফল বাঙালি পুরোপুরি পায়নি বা পেতে পারেনি, এবং এর কারণগুলো বিভিন্ন। কিছু মূল কারণ:
১. রাজনৈতিক অস্থিরতা:
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল এক জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যা দেশের স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের পথে অনেক বাধা সৃষ্টি করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও, পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যাগুলি জাতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।
১৯৭২-৭৫: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল:
মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তিনি দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তবে তার শাসনকালে কিছু বিষয় ছিল যা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয়:
অর্থনৈতিক সংকট: মুক্তিযুদ্ধের কারণে দেশের অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। খাদ্য ও জ্বালানি সংকট, পরবর্তী সময়ে দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অকার্যক্ষমতা দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।
রাজনৈতিক বিভাজন: বঙ্গবন্ধুর সরকার সত্ত্বেও রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের মধ্যে বিভেদ ছিল। গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব ছিল এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এককভাবে শাসন ব্যবস্থা চলছিল, যা বিরোধী দলের জন্য অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বেআইনি কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতি: সরকারে কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, যা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর:
সামরিক শাসন: বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় শাসন গড়ে ওঠে। মেজর জিয়া উদ্দিন আহমেদ, যিনি পরে জিয়াউর রহমান নামে পরিচিত, তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং সামরিক শাসন শুরু করেন।
আইন ও শৃঙ্খলার অবনতি: ১৯৭৫ সালের পর দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং রাজনীতিতে সহিংসতা বেড়ে যায়।
১৯৭৫-১৯৮১: জিয়াউর রহমানের শাসনকাল:
জিয়াউর রহমান প্রথমে সামরিক শাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরে ১৯৭৮ সালে তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক দল **বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (BNP)** প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনকালে:
– **বিরোধী দলের দমন:** সামরিক শাসনের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দমন করা হয় এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়।
– **মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবজ্ঞা:** জিয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে তার নিজস্ব রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা দেশব্যাপী বিরোধ সৃষ্টি করে।
– **অর্থনৈতিক অস্থিরতা:** দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। কৃষি, শিল্প এবং বানিজ্যে ধস নামতে থাকে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।
১৯৮১-১৯৯০ এরশাদের শাসন আমল:
১৯৮১-১৯৯০ পর্যন্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসন আমল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। তাঁর শাসনামলে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলেও, নেতিবাচক প্রভাবগুলোও ছিল ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদি। এরশাদের শাসনামলের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে কিছু মূল বিষয় নিচে তুলে ধরা হলো:
গণতন্ত্রের অবনতি:
- স্বৈরাচারী শাসন: এরশাদ ১৯৮২ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং দীর্ঘ ৮ বছর ধরে দেশের শাসন ব্যবস্থাকে এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে ফেলা হয়, এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়া হয়নি।
- গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ: রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল, এবং বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে হয়রানি ও দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল। রাজনৈতিক দলের সদস্যরা গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হন।
আইন ও শাসনের অবস্থা:
- স্বৈরাচারী আইনগত ব্যবস্থা: এরশাদ সরকার গণতান্ত্রিক সংবিধানকে বদলে দিয়ে এক দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসনের সময় বেশ কিছু অগণতান্ত্রিক আইন চালু করা হয়, যেমন- অর্ডিন্যান্স ৫৭, যা রাজনৈতিক সমালোচনাকে দমন করতে ব্যবহৃত হত।
- সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আধিপত্য: সরকার পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সামরিক বাহিনীর প্রভাব বিস্তার করে, যা আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে।
অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ:
- অর্থনৈতিক বৈষম্য: এরশাদের শাসনকালে কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও, অধিকাংশ জনগণের জন্য তা সঠিকভাবে উপকারে আসেনি। দেশের অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ হয়নি। ধনকুবের ও ক্ষমতাশালীদের জন্য সুবিধা বাড়ানো হলেও গরীব মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।
- দরিদ্রতা এবং বৈষম্য: শাসনামলে সরকারি খাতে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়, যার ফলে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়।
জাতীয় ঐক্যের অবক্ষয়:
- পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব: এরশাদ সরকারের শাসনে বিরোধী দলগুলোকে পুরোপুরি কোণঠাসা করা হয়েছিল, যা দেশের রাজনৈতিক ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে জাতীয় ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপদে পড়ে।
- বিরোধী দলের দমন-পীড়ন: বিরোধী দলগুলোর ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয়, নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়, এবং আন্দোলনকারীদের ওপর সহিংসতা করা হয়। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
ধর্মীয় রাজনীতি ও জাতিগত সম্পর্ক:
- ধর্মীয় বিষয়গুলোর উপর অতিরিক্ত জোর: এরশাদ তার শাসনামলে ইসলামিক রীতিনীতিকে আরো গুরুত্ব দিতে শুরু করেন, যা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে সংঘর্ষে যায়। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা, শরীয়া আইন সম্পর্কে আলোচনা এবং ইসলামি সংস্কৃতির প্রচার করা হয়। এতে দেশে ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়, যা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে।
- জাতিগত অস্থিরতা: এরশাদ সরকারের কিছু পদক্ষেপের ফলে দেশে জাতিগত সংহতির ক্ষতি হয়েছিল, যেমন আওয়ামী লীগের এবং বিএনপির মত দলগুলোর প্রতি ন্যায্য সমর্থন না দেওয়ার কারণে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়।
গণআন্দোলন ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা:
- গণঅভ্যুত্থান: এরশাদ সরকার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রোধ করতে চেষ্টা করেছিল, তবে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এই অভ্যুত্থান সরকারের অস্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় কারণ ছিল, যা পরে দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষতি:
- আন্তর্জাতিক সম্মানহানি: এরশাদের শাসনামল বিশেষ করে তার অগণতান্ত্রিক শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল। অনেক পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা তাকে স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
এগুলি ছিল ১৯৮১-১৯৯০ সালের মধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসন আমলের প্রধান নেতিবাচক প্রভাব, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সমাজ এবং রাজনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছিল।
১৯৯১: খালেদা জিয়ার শাসনকাল:
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, তার স্ত্রী খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন এবং **বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি** এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার শাসনকালে:
– **রাজনৈতিক অস্থিরতা:** বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় দলই একে অপরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছিল। এর ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা, ধর্মঘট এবং অবরোধের ঘটনা বাড়ে, যা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
– **অর্থনৈতিক অগ্রগতি:** খালেদা জিয়ার শাসনকালে কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো হলেও, দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সঙ্কট ছিল। আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এই উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে।
শেখ হাসিনার শাসনকাল (১৯৯৬-২০০১):
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে পায়। তবে, তার শাসনকালে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্যণীয় ছিল:
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং পরিকল্পনা:
– **গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি:** শেখ হাসিনা এক নতুন উদ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তার শাসনকালে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং দুর্নীতি কিছুটা বেড়ে যায়।
– **অর্থনৈতিক পুনর্গঠন:** শেখ হাসিনা একটি উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন খাতে প্রগতির দিকে কাজ শুরু করেন, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতি, শিক্ষা, এবং স্বাস্থ্য খাতে।
– **সামাজিক উন্নয়ন:** কিছু ক্ষেত্রে সরকারের নীতি প্রণয়ন সফল হয়, বিশেষত নারী শিক্ষা, কৃষি উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য সেবায় কিছু অগ্রগতি ঘটেরাজনৈতিক সংঘর্ষ ও অস্থিরতা:**
বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন:** আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, যার মধ্যে ছিল অবরোধ, ধর্মঘট এবং সহিংসতা।
– **সহিংস আন্দোলন:** ১৯৯৬ সালের আন্দোলন ছিল অনেকটা তীব্র এবং সহিংস। জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি নেতাদের নেতৃত্বে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সহিংসতা, ভাংচুর এবং সংঘর্ষ হয়।
বিএনপির অভিযোগ:** বিএনপি অভিযোগ করেছিল যে শেখ হাসিনা নির্বাচন প্রক্রিয়া ধাপ্পাবাজি করে নিয়েছেন এবং গণতন্ত্রের আদর্শ লঙ্ঘন করেছেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তোলে।
অর্থনৈতিক অবস্থা:
শেখ হাসিনার সরকার দেশটির অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। তবে, বিশ্বব্যাপী বাজারের অস্থিরতা এবং আভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কারণে তা ব্যাপকভাবে সফল হয়নি। কিছু পদক্ষেপ, যেমন কৃষি ভর্তুকি এবং খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ, কিছুটা ফলপ্রসূ হয়েছিল।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি:
এই সময়ে **পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি** (১৯৯৭) স্বাক্ষরিত হয়, যা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অর্জন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতি জনগণের (পার্বত্য বাঙালি এবং পাহাড়ি জনগণের) সঙ্গে সরকারের একটি শান্তি চুক্তি হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং সহিংসতার অবসান ঘটে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বিরোধিতা ও সরকারের পতন:
বিরোধীদের তীব্র বিরোধিতা: আওয়ামী লীগ সরকার যখন তার নানা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছিল, তখন বিরোধী দল বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হয়।
২০০১ সালের নির্বাচন:** ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর ২০০১ সালে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এবং খালেদা জিয়া আবার প্রধানমন্ত্রী হন। এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে চলে যায়, এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পায়।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও আন্দোলন
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি বড় কারণ ছিল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব। প্রায় প্রতি দশকেই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ এবং আন্দোলন চলছিল। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সরকার গঠন এবং ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রতিষ্ঠা এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একে অপরকে ক্ষমতায় আনার চলমান প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও, রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের উন্নয়ন এবং জাতির সম্মিলিত লক্ষ্য অর্জনে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শত্রুতা, সামরিক শাসন, দুর্নীতি এবং অস্থিরতার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বারবার ব্যাহত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ তার পুরোপুরি কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করতে পারেনি।
২০০১-২০০৬ পুনরায় বিএনপির শাসন:
২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর নেতৃত্বে কর্মকর্তা সরকার শাসন করেছিল। এই সময়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে নানা বিতর্কিত এবং নেতিবাচক ঘটনা ও প্রভাব সৃষ্টি করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসন আমলে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন হলেও, তাদের শাসনের বেশ কিছু নেতিবাচক দিকও ছিল, যা দেশ ও জনগণের জন্য ক্ষতিকর ছিল। এই সময়ের প্রধান নেতিবাচক দিকগুলো হল:
গণতন্ত্রের অবক্ষয়:
- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা: ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের শাসন আমলে সংসদীয় গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি উপেক্ষা দেখা যায়। বিরোধী দলগুলোকে কার্যকরভাবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হয়নি, এবং সরকারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ বা সমালোচনা অত্যন্ত কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধী দলগুলোর প্রতি অগণতান্ত্রিক আচরণ করেছিল।
- আইন ও শাসনের অবনতি: সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি হস্তক্ষেপ এবং বিচারকদের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সময়ে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে যায়, এবং রাজনৈতিকভাবে অনুকূল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিচারকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়।
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার:
- বড় পরিসরের দুর্নীতি: বিএনপি শাসনামলে দুর্নীতির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এবং সরকারি দলের নেতাদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি কাজকর্মে অনিয়ম, সরকারি তহবিলের অপব্যবহার, এবং অনৈতিক আর্থিক লেনদেন ব্যাপক হয়।
- ভ্রষ্টাচারের সিস্টেম্যাটিক বিস্তার: ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সরকারের মধ্যে এক ধরণের সিস্টেম্যাটিক দুর্নীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়, যার ফলে দেশের অর্থনীতি ও প্রশাসন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও সন্ত্রাস:
- বিরোধী দলের ওপর সহিংসতা: বিএনপি শাসনকালে বিরোধী দলের (বিশেষ করে আওয়ামী লীগ) সমর্থকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হামলা ও হত্যা বাড়ে। নির্বাচনের সময় বিশেষত ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে, যেখানে বহু লোক নিহত হয় এবং নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন দলের পক্ষে কাজ করার জন্য সমালোচিত হয়।
- সন্ত্রাসী কার্যকলাপ: জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামি চরমপন্থী সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডে সরকারের নীরব সমর্থন ও সহায়তা ছিল, যা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়েছিল। ২০০৪ সালে ১৫ আগস্ট এবং ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরিজ বোমা হামলা (বিশেষত ঢাকায়) দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক করে তোলে।
সাংবাদিকতা ও মিডিয়ার স্বাধীনতার হানি:
- মিডিয়ার দমন-পীড়ন: বিএনপি শাসনামলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কঠোরভাবে দমন করা হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হতো। বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি, সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও আক্রমণ ঘটতে থাকে।
দলীয়করণ ও প্রশাসনিক দুর্বলতা:
- সরকারি দফতরে দলীয় নিয়োগ: প্রশাসন ও সরকারি দফতরগুলোতে বিএনপি দলীয় লোকদের নিয়োগের মাধ্যমে দলীয়করণ এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। এতে প্রশাসন ও সরকারের কার্যক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হয় এবং জনগণের সেবা প্রদান কমে যায়।
- নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনিয়ম: ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়। অভিযোগ উঠেছিল যে, নির্বাচনটি ছিল একপেশে এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের সমর্থকদের উপর নির্যাতন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
অর্থনৈতিক দুরবস্থা:
- অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা: যদিও কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তবে সরকার পরিচালনায় সুশাসন না থাকায়, বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পখাতে ব্যাপক দুরবস্থা সৃষ্টি হয়। মূলত দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে পারেনি।
- মূল্যস্ফীতি এবং বেকারত্ব: সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যায়, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় এবং বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের আর্থিক সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বিরোধী দলের দমন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা:
- বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার হরণ: আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর প্রতি অত্যাচারমূলক আচরণ এবং তাদের আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে, ২০০৪ সালে বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য একটি বড় ধরনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যদিও তিনি বেঁচে যান।
- রাজনৈতিক অস্থিরতা: বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আন্দোলন তীব্র হয়, বিশেষত ২০০৬ সালে নির্বাচনী সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। এতে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি পায়।
জাতীয় নিরাপত্তা এবং সম্পর্কের অবনতি:
- জাতীয় নিরাপত্তার সংকট: বিএনপি সরকারের সময়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার ঘটে। এতে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে।
- আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতি: বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে, বিশেষ করে সরকার ও তার মিত্র দল জামায়াতে ইসলামী চরমপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা বাড়ে।
এগুলি ছিল ২০০১-২০০৬ সালের বিএনপি শাসন আমলের প্রধান নেতিবাচক দিক। এসব কারণে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পরবর্তীতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
২০০৯-২০২৪ পুনরায় আওয়ামী লীগ তথা ফ্যাসিস্ট সরকারের উদ্ভব:
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ (শেখ হাসিনার নেতৃত্বে) সরকারের শাসনামল বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, তবে এ সময়ে দেশের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে কিছু নেতিবাচক দিকও প্রতিফলিত হয়েছে। “ফ্যাসিস্ট” শব্দটি সাধারণত একটি অত্যন্ত কট্টর বা স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়, যা গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মানুষের মৌলিক অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে। এর মধ্যে অনেক নেতিবাচক বিষয় রয়েছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, নাগরিক স্বাধীনতা এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে।
এখানে ২০০৯-২০২৪ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের কিছু নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হলো:
গণতন্ত্রের অবনতি এবং রাজনৈতিক অধিকার হরণ:
- বিরোধী দলের দমন: আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলগুলোর (বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী) ওপর ক্রমাগত দমন-পীড়ন চালিয়ে আসছে। সরকারের সমালোচনা ও বিরোধিতা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার এবং হয়রানি চালিয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- নির্বাচনকালীন সহিংসতা: নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা, ভোট জালিয়াতি এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার জন্য কমিশনের ব্যর্থতা লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ কম ছিল এবং ভোটের প্রচলিত পদ্ধতিতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছিল।
- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ: সংবিধান এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সরকারের হস্তক্ষেপ বেড়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও প্রশাসন সরকারী দলীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে গেছে, যা সরকারের প্রতি স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি ও সমালোচনার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে।
মিডিয়ার স্বাধীনতার অবনতি:
- গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত হয়ে পড়েছে। সরকার বিরোধী মিডিয়া, সাংবাদিক এবং ব্লগারদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার এবং হয়রানি চালিয়েছে। সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়, এবং সরকার নিজে প্রচার মাধ্যমগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
- পক্ষপাতিত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন: সরকারি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে পক্ষপাতিত্বপূর্ণ সংবাদ প্রচার এবং সরকারের অপপ্রচার বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এটি সমাজে বিভাজন এবং অনিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি:
- দুর্নীতির বিস্তার: সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রকল্পগুলির পেছনে ব্যাপক অর্থের অপচয় ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। “ফলস প্রজেক্ট” এবং দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
- স্বজনপ্রীতি ও চাকরি নিয়োগ: সরকারি দফতরে এবং প্রতিষ্ঠানে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে, যা সরকারি প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
অবাধ বিচারের ব্যবস্থা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন:
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব: সরকারের পক্ষ থেকে বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক মামলায় “আদালতের ন্যায়বিচার” প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
- মানবাধিকার লঙ্ঘন: মানবাধিকার সংগঠনগুলি সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধরে, যেমন গুম, হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক বন্দি, অমানবিক আচরণ ইত্যাদি। বিশেষত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশ বাহিনী সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় বর্ণবাদ:
- ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহানুভূতি: সরকার ধর্মীয় দলগুলোর (বিশেষত জামায়াতে ইসলামী) বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক সময় ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠী সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং সরকার তাদেরকে যথাযথভাবে দমন করতে সক্ষম হয়নি।
- সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা: সরকার দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতা এবং শান্তি রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনা বেড়ে গেছে।
অর্থনৈতিক অসমতা:
- ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য: দেশের অর্থনীতি কিছুটা শক্তিশালী হলেও, তা সাধারণ মানুষের জন্য সমানভাবে সুবিধাজনক ছিল না। ধনীদের মধ্যে আরও বেশি বিতরণ এবং দরিদ্রদের মাঝে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কমেছে, এবং তাদের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধার সুযোগ কমে গেছে।
- বেকারত্ব এবং মূল্যস্ফীতি: বেকারত্বের হার বাড়ছে এবং মূল্যস্ফীতি কিছু ক্ষেত্রে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
গণবিরোধী সিদ্ধান্ত এবং দমনমূলক আইন:
- নির্বাচনবিহীন সরকারের কার্যক্রম: ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়। বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করেছিল, এবং নির্বাচনের পরেও বিরোধী দলের আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা হয়।
- ভয়াবহ আইন ও সুরক্ষা পরিস্থিতি: সরকার কড়া নিরাপত্তা আইন এবং পেনাল কোড ব্যবহার করে জনগণের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করেছে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রতিবাদ বা সরকারবিরোধী কাজকর্মে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিরোধী আন্দোলন ও অস্থিরতা:
- বিরোধী আন্দোলন দমন: বিরোধী দলের নেতৃত্বকে কোণঠাসা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত পুলিশি অভিযান, গ্রেপ্তার ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বিরোধী দলের সমাবেশ নিষিদ্ধ করা, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা ইত্যাদি গণতন্ত্রের প্রতি অবিচার হিসেবেই দেখা যায়।
২০০৯-২০২৪ সালের আওয়ামী লীগ সরকার কিছু উন্নয়ন করেছে, কিন্তু তাদের শাসনামলকে একপাক্ষিক এবং স্বৈরাচারী হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করেন। গণতন্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক সহিংসতা প্রধান নেতিবাচক দিকগুলির মধ্যে অন্যতম। এসব কারণে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে।
২. অর্থনৈতিক সংকট:
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, শরণার্থী সমস্যা, খাদ্য সংকট, শিল্প ও কৃষির বিপর্যয়, সব মিলিয়ে দেশে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর পুরোপুরি পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল এবং সাহায্য পাওয়া কঠিন ছিল, এবং সেই কারণে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি।
৩. সামরিক শাসন:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই সামরিক শাসন এবং স্বৈরাচারী সরকারগুলোর আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং পরে ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শৃঙ্খলাকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে মানুষের মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা কার্যত ব্যাহত হয়।
২০০৭-২০০৯ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে পুনরায় সেনাশাসন চলে। এসময়ে রাজনৈতিক সংস্কারের নামে মাইনাস -2 নীতি ফরমুলা প্রয়োগ এ সচেষ্ট হন তৎকালীন সরকার। যা এদেশের জনগণ ভালভাবে গ্রহণ করেনি।
৪. গণতন্ত্রের অস্বীকৃতি:
মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, এবং মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বারবার সামরিক শাসন এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে এই মূল লক্ষ্যগুলো পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। নির্বাচিত সরকারগুলোও জনগণের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে।
৫. জাতীয় ঐক্যের অভাব:
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের জনগণের মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় স্বপ্ন ছিল, কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ এবং মতবিরোধের কারণে সেই ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। দলীয় স্বার্থের জন্য একাধিক সময় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তগুলো উপেক্ষিত হয়।
৬. সংস্কৃতির বৈষম্য:
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার দাবি ছিল। তবে, দেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে সংস্কৃতি, ভাষা এবং জাতীয় পরিচয়ের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে দেশের নানা অংশে সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এইসব কারণের কারণে, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পূর্ণ সুফল বাঙালি জনগণ উপভোগ করতে পারেনি। যদিও স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত হওয়ায় জাতি তার যথাযথ বিকাশের পথে চলতে পারেনি। to be continue…