ভারতের বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহায্য করার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ ছিল, যা রাজনৈতিক, মানবিক, এবং কৌশলগত কারণে পরিস্ফুটিত। এই সাহায্য ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, পাশাপাশি ভারতের জন্য এটি একটি মানবিক এবং নৈতিক দায়বদ্ধতাও ছিল।
১. মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং নৈতিক দায়বদ্ধতা
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং নৈতিক দায়বদ্ধতা ছিল অন্যতম প্রধান কারণ, যার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। ভারত পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশে চালানো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে সাহায্য করেছিল। ভারত যে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিল, তার কিছু মূল দিক রয়েছে:
পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি দমন-পীড়ন অভিযান শুরু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমন করা। এর মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। এই মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, ধর্ষণ, গণধ্বংস এবং অস্থিরতা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
- গণহত্যা ও নির্যাতন: পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা করে, এবং লক্ষ লক্ষ নারীকে ধর্ষণের শিকার করে। হাজার হাজার লোক শরণার্থী হয়ে ভারতে পালিয়ে আসে, যা ভারতের জন্য মানবিক সংকট সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের এই অমানবিক আচরণ ভারতের জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ এবং নৈতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল।
- ভারতের মানবিক সহানুভূতি: ভারত এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি মানবিক সহানুভূতি অনুভব করে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শুরু করে।
শরণার্থী সংকট এবং ভারতীয় সহানুভূতি
পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গণহত্যা চালানোর ফলে দলিত জনগণের সংখ্যা ভারতে চলে আসে। ভারত ১০ মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়, যা এক বিশাল মানবিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
- শরণার্থীদের আশ্রয়: ভারত শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিতে প্রস্তুত হয়। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া, খাদ্য এবং চিকিৎসা প্রদান—এগুলো ছিল ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালিত মানবিক সহায়তা কর্মসূচি। এই অভ্যন্তরীণ সমস্যা ভারতের মধ্যে এক ধরনের মানবিক দায়বদ্ধতা এবং সহানুভূতির অনুভূতি তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি
ভারতের সাধারণ জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশীদের প্রতি সমর্থন এবং সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল। ভারতীয় জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি ছিল গভীর সহানুভূতি, যা তাদেরকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
- প্রচার এবং সমর্থন: ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষ করে চলচ্চিত্র এবং সংবাদ মাধ্যম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানায়। এতে ভারতের জনগণকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি নৈতিক সমর্থন দেয়ার জন্য আরও উৎসাহিত করা হয়েছিল।
- শুধু রাজনীতি নয়, সহানুভূতির মানবিক আবেদন: বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম এবং তাদের উপর পাকিস্তানী বাহিনীর নিপীড়ন দেখে ভারতীয় জনগণ দেশটির পাশে দাঁড়িয়েছিল। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, এক ধরনের মানবিক দায়বদ্ধতা হিসেবেই উপস্থাপিত হয়।
ভারতের আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ
পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা এবং নির্যাতনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হলে, ভারত আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের পক্ষে মানবাধিকার রক্ষায় উচ্চকিত ভূমিকা পালন করে।
- প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরোধিতা: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন সত্ত্বেও, ভারত মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক সমর্থন জানায় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে।
- জাতিসংঘের চাপ: ভারত জাতিসংঘে পাকিস্তানির বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ভারতের সমর্থন
ভারতের সরকার এবং জনগণ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক মহান নেতা হিসেবে সম্মানিত করেছিল। ভারত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়ায়।
ভারতের সহানুভূতির অংশ হিসেবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অংশ নেয়।
- সামরিক সহযোগিতা: ভারত মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, এবং সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গুলি চালিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য সাহস যোগায়।
ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদান করেছিল একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে। পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ হিসেবে, ভারত মানবিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। ভারতের এই সহায়তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা কৌশলগত নয়, বরং মানবিক উদ্বেগ এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেই বিবেচিত।
২. ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তা উদ্বেগ
- পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ: পাকিস্তান তখন ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশ ছিল। ভারত জানতো, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশে একনায়কতন্ত্র চালু রাখে, তবে এটি ভারতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করবে।
- পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক: বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, পাকিস্তান তার সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হারাবে, এবং ভারত তার শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
- আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য: ভারত উপলব্ধি করেছিল যে, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দমন করে রাখে, তাহলে উপমহাদেশের সামরিক শক্তির ভারসাম্য অক্ষুণ্ণ থাকবে, যা ভারতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এজন্য ভারত বাংলাদেশকে মুক্ত করতে পদক্ষেপ নেয়, যাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা কমে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ভারসাম্য বজায় থাকে।
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের সম্পর্ক অনেক গভীর ও কৌশলগত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও, এই ঘটনা ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল। এর মাধ্যমে ভারত তার আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তান এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। এই সম্পর্কটি একাধিক স্তরে প্রকাশিত হয়েছে, যেমন:
ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের জন্য আঞ্চলিক নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ), যদি স্বাধীন না হত, তবে এটি ভারতের জন্য একটি নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করত।
- পাকিস্তান-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা: পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজন এবং কাশ্মীরের সমস্যা এই দুদেশের মধ্যে একের পর এক যুদ্ধ এবং কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানকে দুর্বল করে দেয়, যা ভারতের জন্য আঞ্চলিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার এক ধরনের কৌশল ছিল।
- পাকিস্তান এবং চীন সম্পর্ক: পাকিস্তান চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, যা ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানকে তাদের শক্তিশালী প্রতিবেশী হিসেবে একরকম সেকেলে অবস্থানে ফেলে দেয়, ফলে ভারত নিজের আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
পাকিস্তানকে দুর্বল করা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পাকিস্তানকে একত্রিত দেশ হিসেবে রাখার একটি প্রক্রিয়া ছিল। ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানকে দুটি দেশে বিভক্ত করে দেয়, যার ফলে পাকিস্তান তার আগের শক্তি ও সামরিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল।
- রাজনৈতিক আধিপত্য: ভারত পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চেয়েছিল, কারণ এটি ভারতের প্রভাবের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলিক পদক্ষেপ ছিল। ভারতের জন্য পাকিস্তান ছিল আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ এবং পাকিস্তানের দুর্বলতা ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করেছিল।
- পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক: বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, পাকিস্তানের আর কোনও শক্তিশালী ভূমিকা থাকল না, যা ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে ভারতের কৌশলগত লাভ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের ভূখণ্ডের নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
- আঞ্চলিক সহযোগিতা: স্বাধীন বাংলাদেশ, পাকিস্তান থেকে মুক্ত, ভারতের প্রভাবের মধ্যে আসতে পারত, যা ভারতের আঞ্চলিক শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিল। এটি শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, বরং সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকেও ভারতের জন্য লাভজনক ছিল।
- ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি: পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক স্তরে আরও একা হয়ে পড়ে, এবং ভারত তাতে একটি শক্তিশালী ভূরাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য ভারতের প্রয়াস
ভারতের জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত জয় ছিল না, বরং এটি ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য এবং বিশ্বের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করার একটি পদক্ষেপও ছিল।
- চীনের প্রভাব: পাকিস্তান ছিল চীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র, আর ভারত জানতো যে, চীনের প্রভাবকে ভারতের উপমহাদেশ থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা চীনের পাকিস্তান-সমর্থিত অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়।
- বঙ্গোপসাগরে ভারতের নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ভারত বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে নিজের প্রভাব আরও শক্তিশালী করে, যা এই অঞ্চলে ভারতের সামরিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধি করে।
ভারতীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং জাতীয় স্বার্থ
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, এটি ভারতের জনগণের কাছে একধরণের জাতীয় মর্যাদার অর্জন ছিল। ভারতের সাধারণ জনগণ ও রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন, কারণ এটি তাদের প্রতিবেশী দেশে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা মানুষের প্রতি মানবিক সমর্থন ছিল।
- জাতীয় শৌর্য: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের জন্য একটি জাতীয় অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়, যা পাকিস্তানকে পরাজিত করার মাধ্যমে ভারতের শক্তি ও ক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে দাঁড়ায়।
- মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন: ভারতের জনগণ, বিশেষ করে সামরিক বাহিনী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে, যা রাজনৈতিকভাবে ভারতের জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করে।
ভারতের বিশ্ব রাজনীতিতে অবস্থান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। পাকিস্তান তখন এক বিভক্ত অবস্থায় পড়ে, এবং ভারতের শীর্ষস্থানীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের জন্য একটি কৌশলগত এবং রাজনৈতিক জয় ছিল, যা আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে তার পক্ষে আনতে সাহায্য করেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর এবং কৌশলগত। ভারতের জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানকে দুর্বল করা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভূরাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করা, এবং বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করা—এই সবকিছুরই একটি সমন্বিত পদক্ষেপ ছিল। ভারতের জন্য এটি কেবল একটি মানবিক সহায়তা ছিল না, বরং একটি কৌশলগত এবং নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ ছিল, যা আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
৪. বাংলাদেশের জনগণের প্রতি নৈতিক সমর্থন
ভারত তাদের আঞ্চলিক প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। ভারতের জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামকে সহানুভূতির সাথে দেখেছিল এবং তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্তরে আওয়াজ তুলেছিল।
- জনগণের চাহিদা: ভারতীয় জনগণও অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতি এবং পাকিস্তান-বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতিতে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা একে তাদের দেশের জাতীয় নৈতিকতার অংশ হিসেবে দেখেছিল।
৫. ভারতের সামরিক সাহায্য
ভারত শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমর্থন নয়, বরং সামরিক সাহায্য এবং নির্দেশনাও প্রদান করেছিল। ভারতের সেনাবাহিনী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এবং বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবে মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছিল।
- ইস্টার্ন কমান্ড এবং সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ: ভারত ইস্টার্ন কমান্ড স্থাপন করে, যা বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ করায়, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
- শরণার্থী সমস্যা: ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল, যা ভারতীয় সরকারকে আরও বেশী সক্রিয় হতে বাধ্য করে। শরণার্থী সংকট মোকাবিলা করার জন্য ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়।
৬. আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা
ভারত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল। পাকিস্তান তখন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, তবে ভারত মনে করেছিল যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে পাকিস্তানের একত্রীকরণ বজায় থাকলে, পাকিস্তান তাদের আঞ্চলিক প্রভাব আরো বাড়াতে সক্ষম হবে এবং ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। মোট কথা হল ভারতের দুই পাশে দুই পাকিস্তানকে রেখে ভারতের ঠিকমত ঘুম ধরতো না।
উপসংহার:
ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর প্রধান কারণ ছিল মানবিক সহানুভূতি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, নিজের রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার প্রতি নৈতিক সমর্থন। ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া সাহায্য কেবল সামরিক সমর্থনই নয়, বরং বাংলাদেশকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল।