বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটি পার্লামেন্টারি সিস্টেম ভিত্তিক, যেখানে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করা হয় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। তবে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা ও কার্যকারিতা অনেক সময়ই জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এখানে গণতন্ত্র কিভাবে কাজ করে, তার শক্তি ও দুর্বলতাগুলো কি, এবং আমাদের দেশের পরিস্থিতি কেমন, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

১. গণতন্ত্রের মূল ধারণা

গণতন্ত্র হলো একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে দেশের নাগরিকরা সরাসরি বা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের সরকার নির্বাচন করে। গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হলো:

  • জনগণের মতামত ও অধিকার রক্ষা করা,
  • শাসনব্যবস্থায় সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা,
  • আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের কল্যাণ সাধন।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র মূলত পার্লামেন্টারি সিস্টেম এ পরিচালিত হয়, যেখানে সংসদ নির্বাচন হয় এবং সংসদ থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তবে, এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

২. বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো

বাংলাদেশে গণতন্ত্র চালানোর জন্য একটি পার্লামেন্টারি সিস্টেম অনুসরণ করা হয়। এখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হয় জনগণের ভোটে এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে। দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব রীতিমত প্রথাগত, যেহেতু তিনি সরাসরি নির্বাচিত হন না, বরং সংসদের সদস্যরা তাকে নির্বাচন করেন।

  • জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ৩০০ সদস্যের জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত এবং ২৫০টি আসনে সাধারণ নির্বাচন হয়।
  • প্রধানমন্ত্রী: সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের প্রধান এবং কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
  • রাষ্ট্রপতি: রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের রাষ্ট্রের প্রধান। তবে, রাষ্ট্রপতির ভূমিকা মূলত প্রথাগত এবং নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকে।

৩. গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জগুলো

বাংলাদেশের গণতন্ত্র দীর্ঘকাল ধরে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মধ্যে কিছু প্রধান সমস্যা হলো:

(i) রাজনৈতিক দলীয়করণ এবং সংঘাত

  • বাংলাদেশে রাজনীতি গভীরভাবে দলীয়কৃত, যা অনেক সময় জনগণের জন্য বিভক্তি সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগবিএনপি প্রধান দুই রাজনৈতিক দল হওয়ায়, তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সংঘাতের কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝে মাঝে সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
  • এই দলীয় সংঘাত অনেক সময় নির্বাচনী সহিংসতা, বিরোধী দলের আন্দোলন এবং নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ সৃষ্টি করে, যা গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে।

(ii) বিরোধী দল ও সরকারের সম্পর্ক

  • বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের সম্পর্ক অনেক সময় অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এবং শত্রুতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিরোধী দলগুলি অনেক সময় গণতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা, সুশাসন অভাব এবং নির্বাচনী সহিংসতার অভিযোগ তুলতে থাকে, যার ফলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ আরো তীব্র হয়।

(iii) ভোটের গ্রহণযোগ্যতা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংকট

  • বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময়ে কারচুপির, ভোট ডাকাতির এবং সহিংসতার অভিযোগের মুখে পড়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতিঅসাংবিধানিক আচরণের অভিযোগ উঠে আসে, যা গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস করতে সহায়তা করেছে।
  • নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে সন্দেহ, রাজনৈতিক দলের প্রভাব এবং নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বের কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা নিয়ে সমালোচনা হয়।

(iv) আইনের শাসন এবং মানবাধিকার

  • বাংলাদেশের গণতন্ত্রে অনেক সময় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলিও মাঝে মাঝে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে, যেমন অভ্যন্তরীণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, এবং প্রেসের ওপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ
  • মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিষিদ্ধ বা দমন করা হতে পারে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য বিপজ্জনক।

(v) নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা

  • বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট স্বাধীন এবং কার্যকরী হওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদিও সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন, তবে অনেক সময় এটি সরকারের প্রভাবের অধীনে কাজ করার অভিযোগ পায়, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর প্রশ্ন তোলে।

৪. গণতন্ত্রের শক্তি

তবে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কিছু শক্তিও রয়েছে, যা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আশা জাগায়:

(i) জনগণের অংশগ্রহণ

  • বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী এবং একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। প্রতিবাদ, আন্দোলন এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

(ii) গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা

  • যদিও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিছুটা সীমাবদ্ধ, তবুও বাংলাদেশে গণমাধ্যম অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টেলিভিশন, প্রিন্ট মিডিয়া, এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম-গুলো জনগণের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

(iii) আন্তর্জাতিক চাপ এবং সমর্থন

  • আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কার্যক্রমের উপর আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং চাপ রয়েছে। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গণতন্ত্রের উন্নতি ও মানবাধিকার রক্ষায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করে।

৫. উপসংহার

বাংলাদেশের গণতন্ত্র নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও, এটি এখনও প্রক্রিয়াগতভাবে শক্তিশালী এবং উন্নতির পথে রয়েছে। যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনী সংকট, এবং আইনের শাসন বিষয়ক সমস্যা রয়েছে, তবুও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জনগণের অংশগ্রহণ কিছু শক্তির ভিত রচনা করেছে। ভবিষ্যতে যদি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরো সুষ্ঠু, আইনত এবং নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র গড়ে উঠতে পারে।