1. admin@kp-nat.com : admin : Ayub Ali
  2. ayub.bhs@gmail.com : Ayub ali : Ayub ali
রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ০৫:১০ পূর্বাহ্ন

ইসরাইল কি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় হুমকি?

  • Update Time : সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৪৫ Time View

ইসরাইলের ভূমিকা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় হুমকি কিনা, তা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রশ্ন, যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। এই প্রশ্নটির উত্তর নির্ভর করে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা উপাদানের উপর।

১. ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধ

ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধ একটি দীর্ঘকালীন এবং জটিল আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব, যা শতাব্দীজুড়ে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিগত এবং ঐতিহাসিক কারণে বিবর্তিত হয়েছে। এই বিরোধের মূল বিষয় হলো ভূমি, জাতিগত অধিকার, এবং আত্মনির্ধারণের প্রশ্ন। এর মধ্যে ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের জনগণের মধ্যে অনেক ঐতিহাসিক ক্ষোভ এবং দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।

ইতিহাসের পটভূমি

অটোমান যুগ (১৫১৭–১৯১৭)

ইসরাইল-প্যালেস্টাইন অঞ্চলের ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল। প্রথমত, এই অঞ্চলটি শতাব্দীজুড়ে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, বৃটিশরা ১৯১৭ সালে এই অঞ্চলটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় (বৃটিশ ম্যান্ডেট)। তখনকার দিনে এটি “প্যালেস্টাইন” নামে পরিচিত ছিল।

বৃটিশ ম্যান্ডেট (১৯১৭–১৯৪৮)

বৃটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে, প্যালেস্টাইনে ইহুদি অভিবাসন বাড়াতে থাকে, যা ছিল জিওর (জুদের) স্বদেশ প্রতিষ্ঠার একটি ইহুদি আন্দোলন, যা সিয়োনিজম নামে পরিচিত। ১৯১৭ সালে বৃটিশ সরকার ‘ব্যালফার ডিক্লারেশন’ প্রকাশ করে, যা ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে একটি জাতীয় ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পক্ষে সমর্থন জানায়। এর ফলে, ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে আরও বেশি আসতে শুরু করে, যা স্থানীয় আরবদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

১৯৪৮: ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা এবং প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ

বৃটিশ ম্যান্ডেট শেষ হলে, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার পরিকল্পনা প্রস্তাব করে—একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র। তবে আরব দেশগুলো এবং প্যালেস্টাইনিরা এই সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে আরব দেশগুলো যুদ্ধ ঘোষণা করে, যা “প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ” হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধের ফলে ইসরাইল অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেয়, এবং প্রায় ৭ লাখ প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তুরূপে পালিয়ে যায়। এই ঘটনাকে প্যালেস্টাইনিরা “নাকবা” (বিপর্যয়) হিসেবে স্মরণ করে।

মূল বিরোধের কারণসমূহ

১. ভূমি বিতর্ক

প্যালেস্টাইন এবং ইসরাইলের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিতর্ক হলো ভূমি নিয়ে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর, প্যালেস্টাইনিরা তাদের ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া বা জোরপূর্বক পালিয়ে যাওয়ার শিকার হয়। অধিকৃত পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং পূর্ব জেরুজালেমের অবস্থান আজও বিরোধের মূল কেন্দ্র।

২. জাতীয় আত্মনির্ধারণ

প্যালেস্টাইনিরা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার দাবি করে, যা জাতিসংঘের স্বীকৃতির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক স্তরে সমর্থিত। অপরদিকে, ইসরাইল তার অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে সশস্ত্র আক্রমণ ও সন্ত্রাসী হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

৩. ধর্মীয় উপাদান

ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইন উভয়েরই ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। প্যালেস্টাইনের মুসলিম জনগণের জন্য আল-আকসা মসজিদ এবং ইসরাইলের ইহুদি জনগণের জন্য তৃতীয় মন্দিরের স্থান (যা বর্তমানে আল-আকসা মসজিদের সন্নিকটে) রয়েছে, যা ধর্মীয় উত্তেজনার কারণ।

৪. বসতি স্থাপন

পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি স্থাপনও একটি বড় বিতর্কের বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অধিকাংশ সময় এসব বসতিগুলোকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু ইসরাইল সরকার সেগুলোকে বৈধ বলে দাবি করে এবং সেখানে আরও বসতি স্থাপন করতে থাকে।

শান্তি প্রচেষ্টা

ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধের সমাধানে বহুবার শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তবে কোনোভাবেই স্থায়ী সমাধান মেলে নি।

১. ১৯৯৩ সালের ওসলো চুক্তি

১৯৯৩ সালে ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) “ওসলো চুক্তি” স্বাক্ষর করে, যা এক ধাপ এগিয়ে যায় দুই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দিকে। চুক্তি অনুযায়ী, প্যালেস্টাইনের জন্য কিছু সীমিত স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়, কিন্তু চুক্তির পরও শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নানা বাধা ও অগ্রগতির অভাব দেখা দেয়।

২. ২০০০ সালের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা

১৯৯৩ সালে ওসলো চুক্তি সই হওয়ার পর কিছু সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা জাগলেও ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (প্যালেস্টাইনি বিদ্রোহ) শুরু হয়, যা সহিংসতা এবং উত্তেজনা বাড়ায়।

৩. ২০০৭ সালে হামাসের গাজা দখল

২০০৭ সালে, হামাস প্যালেস্টাইনের গাজা উপত্যকা দখল করে নেয়, যার পর থেকে গাজা এবং পশ্চিম তীরের প্যালেস্টাইনিরা দুইটি আলাদা রাজনৈতিক শক্তিতে বিভক্ত হয়ে যায়। হামাস এবং ফাতাহ (প্যালেস্টাইনী কর্তৃপক্ষের মূল রাজনৈতিক দল) মধ্যে বিরোধের ফলে ঐক্যবদ্ধ প্যালেস্টাইনিরা শান্তি আলোচনা থেকে দূরে চলে যায়।

বর্তমানে পরিস্থিতি

বর্তমানে ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধ অনেক জটিল এবং সংকটময়। ইসরাইলের সরকার একদিকে বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে প্যালেস্টাইনিরা তাদের স্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছে। গাজা এবং পশ্চিম তীরে সহিংসতা বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে এবং দুই পক্ষের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু দেশ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যস্থতা করছে, তবে এখন পর্যন্ত একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভব হয়নি।

ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধের সমাধান একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মূল সমস্যা হলো ভূখণ্ডের অধিকার, জাতিগত স্বতন্ত্রতা, এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, এবং উভয় পক্ষের মধ্যে প্রকৃত সংলাপ এবং আপস।

২. আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বিরোধিতা

ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধের মধ্যে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও বিরোধিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একটি বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, যার সাথে অনেক দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং কূটনৈতিক স্বার্থ জড়িত। বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের নিজস্ব অবস্থান ও স্বার্থের ভিত্তিতে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন বা বিরোধিতা জানায়। এখানে প্রধান কিছু দৃষ্টিকোণ তুলে ধরা হলো:

ইসরাইলের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধান কৌশলগত অংশীদার এবং তার প্রতিষ্ঠা থেকে ইসরাইলের শক্তিশালী সমর্থক। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের পর, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক, অর্থনৈতিক, এবং কূটনৈতিকভাবে সহায়তা প্রদান করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন সাধারণত ইসরাইলের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানায়। ২০২১ সালে, জো বাইডেন প্রশাসনও ইসরাইলের প্রতি একইভাবে সমর্থন প্রকাশ করেছে, যদিও কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সমালোচনাও করা হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে কিছু দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ও ফ্রান্স, ইসরাইলের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং তার নিরাপত্তা এবং অস্তিত্বের অধিকারকে সমর্থন করে। তবে ইউরোপের অনেক দেশ ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে, বিশেষ করে পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপন এবং গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের কারণে। EU ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে থাকে, এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার আহ্বান জানায়।

কানাডা

কানাডাও সাধারণত ইসরাইলের প্রতি সমর্থন জানায়, তবে সে দেশের সরকারও ইসরাইলের কিছু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে, বিশেষ করে গাজা পরিস্থিতি এবং বসতি স্থাপনের নীতি নিয়ে।

অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়া ইসরাইলের প্রতি একটি শক্তিশালী সমর্থক দেশ, এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে তারা প্যালেস্টাইনের অধিকার নিয়ে সমালোচনা করতে বা সমঝোতার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানাতে দেখা যায়।

আন্তর্জাতিক ইহুদি সম্প্রদায়

বিশ্বজুড়ে ইহুদি সম্প্রদায় সাধারণত ইসরাইলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে থাকে। ইহুদি জনগণ, বিশেষ করে সিয়োনিস্ট আন্দোলনের সমর্থকরা, ইসরাইলকে ইহুদি জাতির জন্য ঐতিহাসিক ভূমি এবং তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।

ইসরাইলের প্রতি আন্তর্জাতিক বিরোধিতা

আরব ও মুসলিম বিশ্ব

আরব এবং মুসলিম দেশগুলো সাধারণত প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়ায় এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে, এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ ইসরাইলের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে বহুবার যুদ্ধ করেছে (যেমন ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, এবং ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ)। যদিও কিছু আরব দেশ বর্তমানে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে (যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরব), তবুও অধিকাংশ আরব দেশ এখনও প্যালেস্টাইনিদের স্বাধীনতার পক্ষে এবং ইসরাইলের বসতি স্থাপন, পশ্চিম তীরের দখল, এবং গাজায় হামলার নিন্দা জানায়।

তুরস্ক

তুরস্ক ঐতিহাসিকভাবে প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জানায় এবং ইসরাইলের সঙ্গে বিরোধিতা করে থাকে। তুরস্ক ইসরাইলের গাজায় আক্রমণ এবং প্যালেস্টাইনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা করে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্যালেস্টাইনের পক্ষ নিতে থাকে।

ইরান

ইরান সরাসরি ইসরাইলের বিরোধী এবং প্যালেস্টাইনিদের সমর্থন করে। ইরান ইসরাইলকে “অবৈধ রাষ্ট্র” হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার মুসলিম প্রতিবেশী দেশগুলোকে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান নিতে উত্সাহিত করে। ইরান হামাস এবং হিজবুল্লাহর মতো গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিয়ে থাকে, যারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে।

ভারত

ভারত ঐতিহাসিকভাবে প্যালেস্টাইনের অধিকারকে সমর্থন করে এসেছে এবং ইসরাইলের বসতি স্থাপন এবং পশ্চিম তীরের দখল নিয়ে সমালোচনা করেছে। তবে গত কয়েক বছরে ভারত ইসরাইলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক শক্তিশালী করেছে, বিশেষ করে সামরিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে। ভারতের অবস্থান এখন কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ, যেখানে তারা প্যালেস্টাইনের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়, তবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কও বজায় রাখে।

জাতিসংঘ (UN)

জাতিসংঘ সাধারণভাবে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে থাকে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন UNHCR, UNESCO, এবং UNRWA প্যালেস্টাইনি শরণার্থী এবং মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে। ১৯৬৭ সালের পরে ইসরাইলের পশ্চিম তীর, গাজা, এবং পূর্ব জেরুজালেমের দখল নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। ইউএনএসসি (জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ) এবং সাধারণ পরিষদ প্রায়শই ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানায়।

আফ্রিকা

আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জানায় এবং তাদের স্বাধীনতার অধিকারের পক্ষে দাঁড়ায়। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু আফ্রিকান দেশ যেমন মরক্কো, সুদান এবং চাদ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে, যা রাজনৈতিক বিবেচনার ফলস্বরূপ।

আন্তর্জাতিক শান্তি প্রক্রিয়া ও উদ্যোগ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থা শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিজেদের ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলো হলো:

  • জাতিসংঘের উদ্যোগ: জাতিসংঘের বিভিন্ন রেজুলেশন এবং উদ্যোগ যেমন ১৯৬৭ সালের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন ২৪২, প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে।
  • মধ্যস্থতা: যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং জাতিসংঘ (মধ্যস্থতাকারী) একত্রে “কোয়াড” গঠন করে শান্তিপূর্ণ সমাধান চেষ্টার চেষ্টা করছে।
  • ওসলো চুক্তি (১৯৯৩): ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সই হয়েছিল, যদিও তা টেকসই হয়নি।

ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বিরোধিতা বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের কৌশলগত, রাজনৈতিক, এবং ধর্মীয় মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব এবং বিভিন্ন দেশের অবস্থান এই বিরোধের সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে।

৩. ইসরাইলের সামরিক শক্তি

ইসরাইলের সামরিক শক্তি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং আধুনিক। ইসরাইল, তার ক্ষুদ্রতা সত্ত্বেও, অত্যন্ত উন্নত সামরিক প্রযুক্তি এবং দক্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে পরিচিত। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী মূলত তিনটি শাখায় বিভক্ত: ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনী (IDF), মোসাদ (গোপন গোয়েন্দা সংস্থা), এবং শিন বেত (ভিতরকার নিরাপত্তা সংস্থা)। ইসরাইলের সামরিক শক্তি দেশটির নিরাপত্তা এবং অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি দেশটির প্রতিরক্ষা নীতির কেন্দ্রে অবস্থান করে।

ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনী (IDF)

ভূমিকা ও গঠন

ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনী (IDF) ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি ইসরাইলের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। IDF-এর প্রধান তিনটি শাখা:

  • স্থল সেনা (Israel Defense Forces – Ground Forces): এটি ইসরাইলের স্থল বাহিনী এবং গ্রাউন্ড অপারেশন পরিচালনা করে। এটি পশ্চিম তীর, গাজা, এবং সীমান্তে নিরাপত্তা বজায় রাখতে সক্রিয়।
  • বিমান বাহিনী (Israeli Air Force – IAF): ইসরাইলের বিমান বাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী এবং আধুনিক। এটি বিমান হামলা, ড্রোন অপারেশন, বোমা ফেলা, এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় পারদর্শী।
  • নৌবাহিনী (Israeli Navy): ইসরাইলের নৌবাহিনী প্রধানত ভূমধ্যসাগরের উপকূলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং সাগরপথে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এটি সাবমেরিন এবং দ্রুতগতির নৌযান দিয়ে সজ্জিত।

অপারেশনাল ক্ষমতা

  • যুদ্ধ দক্ষতা: IDF অত্যন্ত প্রশিক্ষিত এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। এটি কয়েকটি সামরিক অভিযানে (যেমন ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধ, ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপুর যুদ্ধ, এবং ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ) সফলভাবে অংশ নিয়েছে।
  • যুদ্ধের প্রস্তুতি: ইসরাইলের প্রতিরক্ষা নীতি হলো “অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা”, অর্থাৎ তারা যুদ্ধ শুরুর আগেই আক্রমণকারী শত্রুকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। দেশটি নিয়মিত সামরিক মহড়া এবং প্রস্তুতির মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত রাখে।

আইন, প্রযুক্তি ও অস্ত্রের উন্নয়ন

পারমাণবিক অস্ত্র

ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে সরকার কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি, তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে ইসরাইল পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ করে এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হতে পারে। এর ফলে ইসরাইল তার প্রতিরক্ষা এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম।

মিসাইল প্রযুক্তি

ইসরাইল মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন আইরন ডোম (Iron Dome), অ্যাডির (Arrow), এবং ডেভিডস স্লিং (David’s Sling) ব্যবহার করে। এই সিস্টেমগুলি শত্রু মিসাইল, রকেট এবং গুলি শনাক্ত করে এবং বিপজ্জনক আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম।

  • আইরন ডোম: ছোট এবং মাঝারি দূরত্বের রকেট এবং শেল প্রতিহত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ইসরাইলের নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
  • অ্যাডির (Arrow): এটি একটি উচ্চ-উচ্চতায় আক্রমণকারী ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিহত করতে ব্যবহৃত হয়।
  • ডেভিডস স্লিং: এটি আকাশে নীচু থেকে মাঝারি উচ্চতায় চলমান রকেট প্রতিহত করতে সক্ষম।

ড্রোন প্রযুক্তি

ইসরাইল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ড্রোন প্রযুক্তির বিকাশকারী দেশ। ইসরাইলি ড্রোন (যেমন হারোপ, হারপুন) যুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু বা সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা করতে ব্যবহৃত হয়। ইসরাইল ড্রোন প্রযুক্তি রপ্তানি করে, এবং এটি বিশ্বের বহু দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাইবার যুদ্ধ

ইসরাইলের সাইবার প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণ ক্ষমতা বিশ্বমানের। ইসরাইলি সাইবার ইউনিট, বিশেষ করে ইসরাইলের ৮২০০ ইউনিট (IDF’s Unit 8200), সাইবার হামলা এবং প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞ। ইসরাইল সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এবং সাইবার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।

সামরিক বাজেট এবং সরঞ্জাম

ইসরাইলের সামরিক বাজেট প্রতিবছর অনেক বড়, যদিও এটি দেশের মোট জিডিপির একটি ছোট অংশ (প্রায় ৫-৬%)। তবে ইসরাইল নিজের সামরিক প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনীর মাধ্যমে তা মুনাফাভিত্তিকভাবে ঘুরিয়ে আনে। ইসরাইল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ, এবং তার অস্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান (যেমন ফ-১৬, ফ-৩৫)
  • এমবিটি (মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক), যেমন মার্কাভা ট্যাঙ্ক যা শক্তিশালী এবং নিরাপদ।
  • ছোট অস্ত্র, হেলিকপ্টার, সামুদ্রিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।

বাহিনী এবং জনবল

ইসরাইলের সেনাবাহিনী একটি স্বতন্ত্র বিশেষত্ব হলো অভিযানকালীন সামরিক সেবা। ইসরাইলের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী রাখতে সেখানে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সেবা রয়েছে। সাধারণত, পুরুষদের জন্য ৩ বছর এবং মহিলাদের জন্য ২ বছর সেনাবাহিনীতে সেবা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে, যা দেশের সামরিক বাহিনীকে জনগণের মধ্যে গভীরভাবে সংযুক্ত করে।

মোসাদ (Mossad) এবং শিন বেত (Shin Bet)

  • মোসাদ: ইসরাইলের বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা, যার মূল কাজ হলো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সমস্যা সমাধান এবং সন্ত্রাসবাদ, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং অন্য ধরনের আঞ্চলিক হুমকি মোকাবেলা করা।
  • শিন বেত: এটি ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা, যা দেশীয় সন্ত্রাসবাদ, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং সরকারবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

ইসরাইলের সামরিক শক্তি আধুনিক, শক্তিশালী, এবং অত্যন্ত দক্ষ, যা দেশটির অস্তিত্ব এবং নিরাপত্তা রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র, উন্নত মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ড্রোন প্রযুক্তি, সাইবার যুদ্ধের ক্ষমতা, এবং অভিজ্ঞ সেনাবাহিনী ইসরাইলকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করেছে। এই সামরিক শক্তি ইসরাইলকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে উত্তেজনা এবং সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম করে।

৪. ইসরাইলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

ইসরাইলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল এবং গতিশীল, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক, কৌশলগত, ধর্মীয়, এবং আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে। ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৮ সালে হলেও তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি দীর্ঘ ইতিহাস এবং ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:

ইসরাইলের সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে

যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সবচেয়ে শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদার এবং সমর্থক। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরাইলের অস্তিত্ব এবং নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এটি শুধু রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সমর্থন নয়, বরং সামরিক এবং আর্থিক সহায়তাও সরবরাহ করে।

  • সামরিক সহায়তা: যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা প্রদান করে, যার মধ্যে বিমান, অস্ত্র, প্রযুক্তি, এবং নিরাপত্তা সহায়তা অন্তর্ভুক্ত।
  • সাংবাদিকতা এবং কূটনৈতিক সমর্থন: যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত ইসরাইলের অবস্থানকে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় সমর্থন করে, বিশেষ করে ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিষয়ক আলোচনা এবং নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনগুলোতে। ২০১৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষে একতরফাভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন ২৩৩৪ প্রত্যাখ্যান করে।
  • সিয়োনিজমের সমর্থন: যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজনৈতিক নেতা এবং শক্তিশালী ইহুদি সম্প্রদায় ইসরাইলের পক্ষের পক্ষে এবং সিয়োনিজমের সমর্থক।

ইসরাইলের সম্পর্ক আরব এবং মুসলিম বিশ্বে

ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে, অধিকাংশ আরব দেশ এবং মুসলিম রাষ্ট্র ইসরাইলকে অবৈধ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয় এবং পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকটি যুদ্ধ (যেমন ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধ) সংঘটিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আরব দেশ ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে, যার মধ্যে ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তি একটি বড় ঘটনা।

  • আব্রাহাম চুক্তি: ২০২০ সালে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, এবং পরে মরক্কো এবং সুদান ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এটি একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন, কারণ এসব দেশ একসময় ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি। এই চুক্তিগুলি মূলত অর্থনৈতিক, সামরিক, এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
  • আঞ্চলিক কৌশলগত সম্পর্ক: কিছু আরব দেশ (যেমন সৌদি আরব) গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেও, তারা সাধারণত প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন জানিয়ে থাকে। তবে, এই নতুন সম্পর্কের প্রেক্ষিতে কিছু দেশ ইসরাইলের সঙ্গে গোপন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে ইরান এবং তুরস্কের বিপক্ষে একে অপরকে কৌশলগতভাবে সহায়তা করার জন্য।

ইসরাইলের সম্পর্ক ইউরোপের সঙ্গে

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) এবং ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ইসরাইলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক, এবং নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরাইলের কিছু নীতি, বিশেষ করে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন নিয়ে সমালোচনা করেছে।

  • শান্তি প্রক্রিয়ায় ভূমিকা: ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তি আলোচনা প্রক্রিয়া এবং দুই রাষ্ট্রের সমাধানের পক্ষে কাজ করতে চায়। ইউরোপিয়ান নেতারা প্রায়ই ইসরাইলকে প্যালেস্টাইনিদের অধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে চাপ দেন।
  • বাণিজ্য ও সহযোগিতা: ইউরোপ ইসরাইলের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ইসরাইল প্রযুক্তি, বিশেষত সাইবার সিকিউরিটি, ড্রোন প্রযুক্তি, এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।
  • মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন: ইউরোপীয় দেশগুলো মাঝে মাঝে ইসরাইলের পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপন এবং গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান সমালোচনা করে, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করা হয়।

ইসরাইলের সম্পর্ক এশিয়ার সঙ্গে

এশিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক বিভিন্নভাবে বিস্তৃত হয়েছে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে।

  • ভারত: ভারত এবং ইসরাইলের সম্পর্ক গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে, ভারত ইসরাইলের সঙ্গে সামরিক, প্রযুক্তি, এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে। ইসরাইল ভারতের শত্রুদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহ করে, যেমন পাকিস্তান এবং চীনের বিরুদ্ধে।
  • চীন: চীনও ইসরাইলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, বিশেষ করে প্রযুক্তি এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে। চীন ইসরাইলের উচ্চ প্রযুক্তি ও ড্রোন সরবরাহের দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
  • আফগানিস্তান, পাকিস্তান, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া: ইসরাইল এই অঞ্চলে তার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণা এবং সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে, যদিও এখানকার মুসলিম দেশগুলো সাধারণত ইসরাইলের বিরুদ্ধে থাকে এবং প্যালেস্টাইনের পক্ষে অবস্থান নেয়।

ইসরাইলের সম্পর্ক আফ্রিকার সঙ্গে

ইসরাইল আফ্রিকার বেশ কিছু দেশেও কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যদিও ঐতিহাসিকভাবে অনেক আফ্রিকান দেশ প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে।

  • দক্ষিণ সুদান, ইথিওপিয়া, এবং কেনিয়া: এই দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন সহযোগিতা রয়েছে। ইসরাইল আফ্রিকান দেশগুলোর কৃষি, জলসম্পদ, এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করে।
  • ইসরাইলের সমালোচনা: কিছু আফ্রিকান দেশ এখনও প্যালেস্টাইনের পক্ষ নিয়ে থাকে, তবে ইসরাইল আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিয়ে যাচ্ছে।

ইসরাইলের সম্পর্ক লাতিন আমেরিকার সঙ্গে

লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ, বিশেষ করে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, এবং চিলি, ইসরাইলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তবে, প্যালেস্টাইনের প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও, এসব দেশ রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, এবং সামরিক দিক থেকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে।

  • ভেনিজুয়েলা এবং কিউবা: এসব দেশে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে এবং প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে।
  • ব্রাজিল: ব্রাজিলের নতুন সরকারও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করতে চাইছে, বিশেষ করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিছু সমালোচনা রেখে।

ইসরাইলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং তার কূটনীতি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক এবং কিছু আরব দেশের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপন ইসরাইলের কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে, তবে আন্তর্জাতিক মহলে প্যালেস্টাইন এবং মানবাধিকার বিষয়ক চ্যালেঞ্জও বিরাজমান।

৫. মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের চ্যালেঞ্জ

ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধ এবং ইসরাইলের সামরিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত মানবাধিকারআন্তর্জাতিক আইন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম জটিল এবং বিতর্কিত বিষয়। ইসরাইলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, প্যালেস্টাইনের জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে ধারাবাহিক বিতর্ক রয়েছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের চ্যালেঞ্জ আলোচনা করা হলো:

পশ্চিম তীর ও গাজায় বসতি স্থাপন

ইসরাইলের পশ্চিম তীর এবং গাজা এলাকায় ইসরাইলি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিতর্কিত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সমালোচিত হয়েছে।

  • চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন: ১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৪র্থ অধ্যায়ের ধারা ৪৯ অনুযায়ী, কোনো শক্তির পক্ষ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বা দখলকৃত অঞ্চলে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ। এই আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুযায়ী, ইসরাইলের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরাইলি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়।
  • ইসরাইলের অবস্থান: ইসরাইলের সরকার দাবি করে, পশ্চিম তীরের বসতিগুলির জন্য কোনো আইনগত বাধা নেই, কারণ তারা এটিকে “বিবেচনাধীন অঞ্চল” হিসেবে গণ্য করে এবং সেখানে বসবাসরত ইহুদি জনগণের “ঐতিহাসিক অধিকার” দাবি করে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বসতি স্থাপনকে অবৈধ বলে বিবেচনা করে, এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসরাইলকে বসতি স্থাপন বন্ধ করার জন্য চাপ দিয়েছে।

গাজা উপত্যকায় সামরিক আক্রমণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন

গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানগুলিও মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের মুখে রয়েছে। বিশেষ করে গাজা যুদ্ধ (২০০৮-২০০৯, ২০১২, ২০১৪, ২০২১) এবং অন্যান্য সামরিক অভিযানের সময়:

  • বেসামরিক মানুষের ক্ষতি: গাজার প্রতিবন্ধী, শিশু, এবং অসামরিক জনগণের প্রতি সহিংসতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনা পায়। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW), এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বারবার দাবি করেছে যে, গাজার জনগণের ওপর ইসরাইলের আক্রমণগুলির সময় বেসামরিক জনগণ disproportionately ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
  • অস্ত্রের ব্যবহার: ইসরাইল গাজায় অস্বাভাবিক শক্তি ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে, যেখানে বোমা হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র, এবং আকাশ থেকে গুলি চালানোর ফলে অনেক বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গাজার অবরোধের ফলে মানবিক সংকটও বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ইসরাইলের বেসামরিক অবকাঠামোকে ধ্বংস করার জন্য হামলা চালানো হয়েছে।

প্যালেস্টাইনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা

ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং “অতিরিক্ত শক্তি” ব্যবহারের ব্যাপারেও অভিযোগ রয়েছে।

  • অপহরণ এবং নির্যাতন: ইসরাইলি বাহিনী বিশেষ করে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে প্যালেস্টাইনিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় বা প্রান্তিক মানুষের বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, এবং অনৈতিক গ্রেপ্তারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।
  • অযাচিত গুলি চালানো: ইসরাইলি সেনারা প্যালেস্টাইনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে গুলি চালিয়ে এবং “বাড়াবাড়ি সহিংসতার” কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দিত হয়েছে।

জাতিসংঘের রেজুলেশন এবং আন্তর্জাতিক চাপ

জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অনেক বার রেজুলেশন পাস করেছে, তবে ইসরাইল বেশিরভাগ সময়ই এই রেজুলেশনগুলিকে উপেক্ষা করেছে।

  • জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ: ইসরাইলের পশ্চিম তীর, গাজার সহিংসতা, এবং বসতি স্থাপন নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ বিভিন্ন রেজুলেশন পাস করেছে, যেমন রেজুলেশন ২৪২ (১৯৬৭) এবং রেজুলেশন ২৩৩৪ (২০১৬), যেখানে ইসরাইলকে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
  • ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (ICC): ২০২০ সালে, ICC ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত শুরু করেছে, বিশেষ করে গাজার বেসামরিক মানুষের ওপর আক্রমণ, বসতি স্থাপন, এবং পশ্চিম তীরের দখল নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে। যদিও ইসরাইল ICC-এর এখতিয়ার মেনে নেয়নি এবং এর কার্যক্রমকে অগ্রাহ্য করেছে।

প্যালেস্টাইনের শরণার্থী সমস্যা

প্যালেস্টাইনিদের শরণার্থী হওয়া এবং তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকারের ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানে অন্যতম প্রধান সমস্যা। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ এবং ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ৭০০,০০০ প্যালেস্টাইনি শরণার্থী হয়ে যায়, এবং তাদের অধিকাংশই লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, এবং অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে।

  • প্যালেস্টাইনের অধিকার: প্যালেস্টাইনিদের “ফিরে যাওয়ার অধিকার” এবং তাদের স্থায়ী আবাসের অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের একাধিক রেজুলেশন রয়েছে। তবে, ইসরাইল এই অধিকারকে “আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি” হিসেবে দেখেছে এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসন বা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি স্থায়ী সমাধান দিতে প্রস্তুত নয়।

ইসরাইলি গার্ড এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভূমিকা

ইসরাইলের সরকার এবং সামরিক বাহিনী, মানবাধিকার সংগঠনগুলি এবং আন্তর্জাতিক বিচারিক সংস্থাগুলোর সাথে নিয়মিত সংঘর্ষে থাকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং আল হাক ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। তারা মূলত পশ্চিম তীরের দখল, বসতি স্থাপন, এবং গাজার সামরিক আক্রমণকে লক্ষ্য করে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (UNHRC)

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (UNHRC) ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বারবার রিপোর্ট এবং রেজুলেশন গ্রহণ করেছে। যদিও ইসরাইল মানবাধিকার কাউন্সিলের সমালোচনাকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে বিবেচনা করে, তারপরও অনেক রেজুলেশনে তার কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা হয়েছে।

ইসরাইলের মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলি ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধের কেন্দ্রস্থল এবং এই প্রশ্নগুলো বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, এবং মানবাধিকার আন্দোলনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের বিষয়। ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধান একটি জটিল এবং দুঃসাধ্য লক্ষ্য, যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এবং মানবাধিকার রক্ষা করার প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আমার খবর
© All rights reserved © 2025 Kisukhoner Pathshala
Customized By BlogTheme