ইসরাইলের ভূমিকা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় হুমকি কিনা, তা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রশ্ন, যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। এই প্রশ্নটির উত্তর নির্ভর করে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা উপাদানের উপর।
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধ একটি দীর্ঘকালীন এবং জটিল আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব, যা শতাব্দীজুড়ে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিগত এবং ঐতিহাসিক কারণে বিবর্তিত হয়েছে। এই বিরোধের মূল বিষয় হলো ভূমি, জাতিগত অধিকার, এবং আত্মনির্ধারণের প্রশ্ন। এর মধ্যে ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের জনগণের মধ্যে অনেক ঐতিহাসিক ক্ষোভ এবং দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন অঞ্চলের ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল। প্রথমত, এই অঞ্চলটি শতাব্দীজুড়ে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, বৃটিশরা ১৯১৭ সালে এই অঞ্চলটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় (বৃটিশ ম্যান্ডেট)। তখনকার দিনে এটি “প্যালেস্টাইন” নামে পরিচিত ছিল।
বৃটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে, প্যালেস্টাইনে ইহুদি অভিবাসন বাড়াতে থাকে, যা ছিল জিওর (জুদের) স্বদেশ প্রতিষ্ঠার একটি ইহুদি আন্দোলন, যা সিয়োনিজম নামে পরিচিত। ১৯১৭ সালে বৃটিশ সরকার ‘ব্যালফার ডিক্লারেশন’ প্রকাশ করে, যা ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে একটি জাতীয় ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পক্ষে সমর্থন জানায়। এর ফলে, ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে আরও বেশি আসতে শুরু করে, যা স্থানীয় আরবদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
বৃটিশ ম্যান্ডেট শেষ হলে, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার পরিকল্পনা প্রস্তাব করে—একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র। তবে আরব দেশগুলো এবং প্যালেস্টাইনিরা এই সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে আরব দেশগুলো যুদ্ধ ঘোষণা করে, যা “প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ” হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধের ফলে ইসরাইল অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেয়, এবং প্রায় ৭ লাখ প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তুরূপে পালিয়ে যায়। এই ঘটনাকে প্যালেস্টাইনিরা “নাকবা” (বিপর্যয়) হিসেবে স্মরণ করে।
প্যালেস্টাইন এবং ইসরাইলের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিতর্ক হলো ভূমি নিয়ে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর, প্যালেস্টাইনিরা তাদের ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া বা জোরপূর্বক পালিয়ে যাওয়ার শিকার হয়। অধিকৃত পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং পূর্ব জেরুজালেমের অবস্থান আজও বিরোধের মূল কেন্দ্র।
প্যালেস্টাইনিরা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার দাবি করে, যা জাতিসংঘের স্বীকৃতির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক স্তরে সমর্থিত। অপরদিকে, ইসরাইল তার অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে সশস্ত্র আক্রমণ ও সন্ত্রাসী হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইন উভয়েরই ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। প্যালেস্টাইনের মুসলিম জনগণের জন্য আল-আকসা মসজিদ এবং ইসরাইলের ইহুদি জনগণের জন্য তৃতীয় মন্দিরের স্থান (যা বর্তমানে আল-আকসা মসজিদের সন্নিকটে) রয়েছে, যা ধর্মীয় উত্তেজনার কারণ।
পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি স্থাপনও একটি বড় বিতর্কের বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অধিকাংশ সময় এসব বসতিগুলোকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু ইসরাইল সরকার সেগুলোকে বৈধ বলে দাবি করে এবং সেখানে আরও বসতি স্থাপন করতে থাকে।
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধের সমাধানে বহুবার শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তবে কোনোভাবেই স্থায়ী সমাধান মেলে নি।
১৯৯৩ সালে ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) “ওসলো চুক্তি” স্বাক্ষর করে, যা এক ধাপ এগিয়ে যায় দুই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দিকে। চুক্তি অনুযায়ী, প্যালেস্টাইনের জন্য কিছু সীমিত স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়, কিন্তু চুক্তির পরও শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নানা বাধা ও অগ্রগতির অভাব দেখা দেয়।
১৯৯৩ সালে ওসলো চুক্তি সই হওয়ার পর কিছু সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা জাগলেও ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (প্যালেস্টাইনি বিদ্রোহ) শুরু হয়, যা সহিংসতা এবং উত্তেজনা বাড়ায়।
২০০৭ সালে, হামাস প্যালেস্টাইনের গাজা উপত্যকা দখল করে নেয়, যার পর থেকে গাজা এবং পশ্চিম তীরের প্যালেস্টাইনিরা দুইটি আলাদা রাজনৈতিক শক্তিতে বিভক্ত হয়ে যায়। হামাস এবং ফাতাহ (প্যালেস্টাইনী কর্তৃপক্ষের মূল রাজনৈতিক দল) মধ্যে বিরোধের ফলে ঐক্যবদ্ধ প্যালেস্টাইনিরা শান্তি আলোচনা থেকে দূরে চলে যায়।
বর্তমানে ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধ অনেক জটিল এবং সংকটময়। ইসরাইলের সরকার একদিকে বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে প্যালেস্টাইনিরা তাদের স্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছে। গাজা এবং পশ্চিম তীরে সহিংসতা বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে এবং দুই পক্ষের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু দেশ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যস্থতা করছে, তবে এখন পর্যন্ত একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভব হয়নি।
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধের সমাধান একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মূল সমস্যা হলো ভূখণ্ডের অধিকার, জাতিগত স্বতন্ত্রতা, এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, এবং উভয় পক্ষের মধ্যে প্রকৃত সংলাপ এবং আপস।
২. আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বিরোধিতা
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধের মধ্যে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও বিরোধিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একটি বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, যার সাথে অনেক দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং কূটনৈতিক স্বার্থ জড়িত। বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের নিজস্ব অবস্থান ও স্বার্থের ভিত্তিতে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন বা বিরোধিতা জানায়। এখানে প্রধান কিছু দৃষ্টিকোণ তুলে ধরা হলো:
যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধান কৌশলগত অংশীদার এবং তার প্রতিষ্ঠা থেকে ইসরাইলের শক্তিশালী সমর্থক। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের পর, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক, অর্থনৈতিক, এবং কূটনৈতিকভাবে সহায়তা প্রদান করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন সাধারণত ইসরাইলের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানায়। ২০২১ সালে, জো বাইডেন প্রশাসনও ইসরাইলের প্রতি একইভাবে সমর্থন প্রকাশ করেছে, যদিও কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সমালোচনাও করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে কিছু দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ও ফ্রান্স, ইসরাইলের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং তার নিরাপত্তা এবং অস্তিত্বের অধিকারকে সমর্থন করে। তবে ইউরোপের অনেক দেশ ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে, বিশেষ করে পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপন এবং গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের কারণে। EU ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে থাকে, এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার আহ্বান জানায়।
কানাডাও সাধারণত ইসরাইলের প্রতি সমর্থন জানায়, তবে সে দেশের সরকারও ইসরাইলের কিছু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে, বিশেষ করে গাজা পরিস্থিতি এবং বসতি স্থাপনের নীতি নিয়ে।
অস্ট্রেলিয়া ইসরাইলের প্রতি একটি শক্তিশালী সমর্থক দেশ, এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে তারা প্যালেস্টাইনের অধিকার নিয়ে সমালোচনা করতে বা সমঝোতার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানাতে দেখা যায়।
বিশ্বজুড়ে ইহুদি সম্প্রদায় সাধারণত ইসরাইলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে থাকে। ইহুদি জনগণ, বিশেষ করে সিয়োনিস্ট আন্দোলনের সমর্থকরা, ইসরাইলকে ইহুদি জাতির জন্য ঐতিহাসিক ভূমি এবং তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।
আরব এবং মুসলিম দেশগুলো সাধারণত প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়ায় এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে, এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ ইসরাইলের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে বহুবার যুদ্ধ করেছে (যেমন ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, এবং ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ)। যদিও কিছু আরব দেশ বর্তমানে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে (যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরব), তবুও অধিকাংশ আরব দেশ এখনও প্যালেস্টাইনিদের স্বাধীনতার পক্ষে এবং ইসরাইলের বসতি স্থাপন, পশ্চিম তীরের দখল, এবং গাজায় হামলার নিন্দা জানায়।
তুরস্ক ঐতিহাসিকভাবে প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জানায় এবং ইসরাইলের সঙ্গে বিরোধিতা করে থাকে। তুরস্ক ইসরাইলের গাজায় আক্রমণ এবং প্যালেস্টাইনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা করে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্যালেস্টাইনের পক্ষ নিতে থাকে।
ইরান সরাসরি ইসরাইলের বিরোধী এবং প্যালেস্টাইনিদের সমর্থন করে। ইরান ইসরাইলকে “অবৈধ রাষ্ট্র” হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার মুসলিম প্রতিবেশী দেশগুলোকে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান নিতে উত্সাহিত করে। ইরান হামাস এবং হিজবুল্লাহর মতো গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিয়ে থাকে, যারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে।
ভারত ঐতিহাসিকভাবে প্যালেস্টাইনের অধিকারকে সমর্থন করে এসেছে এবং ইসরাইলের বসতি স্থাপন এবং পশ্চিম তীরের দখল নিয়ে সমালোচনা করেছে। তবে গত কয়েক বছরে ভারত ইসরাইলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক শক্তিশালী করেছে, বিশেষ করে সামরিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে। ভারতের অবস্থান এখন কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ, যেখানে তারা প্যালেস্টাইনের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়, তবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কও বজায় রাখে।
জাতিসংঘ সাধারণভাবে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে থাকে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন UNHCR, UNESCO, এবং UNRWA প্যালেস্টাইনি শরণার্থী এবং মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে। ১৯৬৭ সালের পরে ইসরাইলের পশ্চিম তীর, গাজা, এবং পূর্ব জেরুজালেমের দখল নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। ইউএনএসসি (জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ) এবং সাধারণ পরিষদ প্রায়শই ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানায়।
আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জানায় এবং তাদের স্বাধীনতার অধিকারের পক্ষে দাঁড়ায়। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু আফ্রিকান দেশ যেমন মরক্কো, সুদান এবং চাদ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে, যা রাজনৈতিক বিবেচনার ফলস্বরূপ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থা শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিজেদের ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলো হলো:
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বিরোধিতা বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের কৌশলগত, রাজনৈতিক, এবং ধর্মীয় মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব এবং বিভিন্ন দেশের অবস্থান এই বিরোধের সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে।
৩. ইসরাইলের সামরিক শক্তি
ইসরাইলের সামরিক শক্তি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং আধুনিক। ইসরাইল, তার ক্ষুদ্রতা সত্ত্বেও, অত্যন্ত উন্নত সামরিক প্রযুক্তি এবং দক্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে পরিচিত। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী মূলত তিনটি শাখায় বিভক্ত: ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনী (IDF), মোসাদ (গোপন গোয়েন্দা সংস্থা), এবং শিন বেত (ভিতরকার নিরাপত্তা সংস্থা)। ইসরাইলের সামরিক শক্তি দেশটির নিরাপত্তা এবং অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি দেশটির প্রতিরক্ষা নীতির কেন্দ্রে অবস্থান করে।
ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনী (IDF) ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি ইসরাইলের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। IDF-এর প্রধান তিনটি শাখা:
ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে সরকার কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি, তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে ইসরাইল পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ করে এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হতে পারে। এর ফলে ইসরাইল তার প্রতিরক্ষা এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম।
ইসরাইল মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন আইরন ডোম (Iron Dome), অ্যাডির (Arrow), এবং ডেভিডস স্লিং (David’s Sling) ব্যবহার করে। এই সিস্টেমগুলি শত্রু মিসাইল, রকেট এবং গুলি শনাক্ত করে এবং বিপজ্জনক আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম।
ইসরাইল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ড্রোন প্রযুক্তির বিকাশকারী দেশ। ইসরাইলি ড্রোন (যেমন হারোপ, হারপুন) যুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু বা সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা করতে ব্যবহৃত হয়। ইসরাইল ড্রোন প্রযুক্তি রপ্তানি করে, এবং এটি বিশ্বের বহু দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইসরাইলের সাইবার প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণ ক্ষমতা বিশ্বমানের। ইসরাইলি সাইবার ইউনিট, বিশেষ করে ইসরাইলের ৮২০০ ইউনিট (IDF’s Unit 8200), সাইবার হামলা এবং প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞ। ইসরাইল সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এবং সাইবার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
ইসরাইলের সামরিক বাজেট প্রতিবছর অনেক বড়, যদিও এটি দেশের মোট জিডিপির একটি ছোট অংশ (প্রায় ৫-৬%)। তবে ইসরাইল নিজের সামরিক প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনীর মাধ্যমে তা মুনাফাভিত্তিকভাবে ঘুরিয়ে আনে। ইসরাইল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ, এবং তার অস্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে:
ইসরাইলের সেনাবাহিনী একটি স্বতন্ত্র বিশেষত্ব হলো অভিযানকালীন সামরিক সেবা। ইসরাইলের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী রাখতে সেখানে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সেবা রয়েছে। সাধারণত, পুরুষদের জন্য ৩ বছর এবং মহিলাদের জন্য ২ বছর সেনাবাহিনীতে সেবা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে, যা দেশের সামরিক বাহিনীকে জনগণের মধ্যে গভীরভাবে সংযুক্ত করে।
ইসরাইলের সামরিক শক্তি আধুনিক, শক্তিশালী, এবং অত্যন্ত দক্ষ, যা দেশটির অস্তিত্ব এবং নিরাপত্তা রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র, উন্নত মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ড্রোন প্রযুক্তি, সাইবার যুদ্ধের ক্ষমতা, এবং অভিজ্ঞ সেনাবাহিনী ইসরাইলকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করেছে। এই সামরিক শক্তি ইসরাইলকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে উত্তেজনা এবং সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম করে।
৪. ইসরাইলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
ইসরাইলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল এবং গতিশীল, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক, কৌশলগত, ধর্মীয়, এবং আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে। ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৮ সালে হলেও তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি দীর্ঘ ইতিহাস এবং ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সবচেয়ে শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদার এবং সমর্থক। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরাইলের অস্তিত্ব এবং নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এটি শুধু রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সমর্থন নয়, বরং সামরিক এবং আর্থিক সহায়তাও সরবরাহ করে।
ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে, অধিকাংশ আরব দেশ এবং মুসলিম রাষ্ট্র ইসরাইলকে অবৈধ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয় এবং পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকটি যুদ্ধ (যেমন ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধ) সংঘটিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আরব দেশ ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে, যার মধ্যে ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তি একটি বড় ঘটনা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) এবং ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ইসরাইলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক, এবং নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরাইলের কিছু নীতি, বিশেষ করে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন নিয়ে সমালোচনা করেছে।
এশিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক বিভিন্নভাবে বিস্তৃত হয়েছে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে।
ইসরাইল আফ্রিকার বেশ কিছু দেশেও কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যদিও ঐতিহাসিকভাবে অনেক আফ্রিকান দেশ প্যালেস্টাইনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে।
লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ, বিশেষ করে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, এবং চিলি, ইসরাইলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তবে, প্যালেস্টাইনের প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও, এসব দেশ রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, এবং সামরিক দিক থেকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে।
ইসরাইলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং তার কূটনীতি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক এবং কিছু আরব দেশের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপন ইসরাইলের কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে, তবে আন্তর্জাতিক মহলে প্যালেস্টাইন এবং মানবাধিকার বিষয়ক চ্যালেঞ্জও বিরাজমান।
৫. মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের চ্যালেঞ্জ
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধ এবং ইসরাইলের সামরিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম জটিল এবং বিতর্কিত বিষয়। ইসরাইলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, প্যালেস্টাইনের জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে ধারাবাহিক বিতর্ক রয়েছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের চ্যালেঞ্জ আলোচনা করা হলো:
ইসরাইলের পশ্চিম তীর এবং গাজা এলাকায় ইসরাইলি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিতর্কিত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সমালোচিত হয়েছে।
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানগুলিও মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের মুখে রয়েছে। বিশেষ করে গাজা যুদ্ধ (২০০৮-২০০৯, ২০১২, ২০১৪, ২০২১) এবং অন্যান্য সামরিক অভিযানের সময়:
ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং “অতিরিক্ত শক্তি” ব্যবহারের ব্যাপারেও অভিযোগ রয়েছে।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অনেক বার রেজুলেশন পাস করেছে, তবে ইসরাইল বেশিরভাগ সময়ই এই রেজুলেশনগুলিকে উপেক্ষা করেছে।
প্যালেস্টাইনিদের শরণার্থী হওয়া এবং তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকারের ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানে অন্যতম প্রধান সমস্যা। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ এবং ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ৭০০,০০০ প্যালেস্টাইনি শরণার্থী হয়ে যায়, এবং তাদের অধিকাংশই লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, এবং অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
ইসরাইলের সরকার এবং সামরিক বাহিনী, মানবাধিকার সংগঠনগুলি এবং আন্তর্জাতিক বিচারিক সংস্থাগুলোর সাথে নিয়মিত সংঘর্ষে থাকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং আল হাক ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। তারা মূলত পশ্চিম তীরের দখল, বসতি স্থাপন, এবং গাজার সামরিক আক্রমণকে লক্ষ্য করে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (UNHRC) ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বারবার রিপোর্ট এবং রেজুলেশন গ্রহণ করেছে। যদিও ইসরাইল মানবাধিকার কাউন্সিলের সমালোচনাকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে বিবেচনা করে, তারপরও অনেক রেজুলেশনে তার কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা হয়েছে।
ইসরাইলের মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলি ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিরোধের কেন্দ্রস্থল এবং এই প্রশ্নগুলো বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, এবং মানবাধিকার আন্দোলনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের বিষয়। ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধান একটি জটিল এবং দুঃসাধ্য লক্ষ্য, যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এবং মানবাধিকার রক্ষা করার প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a Reply