বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৫ সালের ২৪শে মার্চ একটি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য ছিল দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অরাজকতা প্রতিরোধ। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে, দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট তখন খুবই অস্থিতিশীল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একে অপরের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল, যা দেশের উন্নয়ন ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল।

একদলীয় শাসন ব্যবস্থা:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর তার পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয়, এবং এর পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। তার মৃত্যুর পর সামরিক শাসনের পথে দেশ চলে যায়। তবে তার জীবনকালে, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে, তিনি যে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি ছিল একটি মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তন।

১. সংবিধান সংশোধন: বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনার মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর সময়কালীন জাতীয় সংসদ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করেছিল, কারণ এটি দেশের রাজনৈতিক ও আইনগত কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তবে, বঙ্গবন্ধুর সময়কালে জাতীয় সংসদের কাঠামো ও কার্যক্রম কিছু পরিবর্তন এবং বিশেষত্ব ছিল, বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর।

১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে **বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ** ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয় লাভ করেছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনের মধ্যে ১৬১টি (সম্পূর্ণ ১৬০টি আসন, ১টি আসন সংখ্যালঘুদের জন্য) পেয়ে প্রাপ্ত আসনের নিরিখে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, যা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে।

তবে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি শাসকরা এই নির্বাচনকে অস্বীকার করে, এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের সূচনা হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের পর জাতীয় সংসদ (১৯৭২)

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালে **বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়, এবং একই বছরে প্রথম জাতীয় সংসদ  গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

১৯৭৩ সালের ৭ম মার্চের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৭০টি আসনের মধ্যে ২৩০টি আসন জয়লাভ করে, এবং এই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় ব্যবস্থার সূচনা হয়।

১৯৭৫ সালের সংবিধান সংশোধন এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা**

১৯৭৫ সালের মার্চে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধন আনেন, যা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দল কার্যক্রম চালানোর সুযোগ পায়নি। এ সময় জাতীয় সংসদ ছিল আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ন্ত্রিত, এবং অন্য দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব ছিল না।

এসময়ে জাতীয় সংসদ ছিল একটি স্বতন্ত্র দলের (আওয়ামী লীগ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যেখানে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সদস্যরা ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংসদ কার্যক্রম পরিচালিত

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তার পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয় এবং সামরিক শাসনের পথ তৈরি হয়। এরপর, **জাতীয় সংসদ** কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন সামরিক সরকার দেশের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কারণে এই সংসদ কার্যকর হয়নি।

১৯৭২-৭৫** সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ছিল একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো, যেখানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে

১৯৭৫ সালের মার্চে** সংসদের কাঠামো পরিবর্তন হয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ** ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারত না।

এভাবে, বঙ্গবন্ধুর সময়কালের জাতীয় সংসদ ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা দেশের গণতান্ত্রিক ও শাসন ব্যবস্থার বিকাশের চ্যালেঞ্জগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে।

স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি খোঁচা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, যেগুলি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের খোঁচা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষত ১৯৭৫ সালের মার্চে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি সীমিত সহিষ্ণুতা এই ধরনের খোঁচার মূল দৃষ্টান্ত।

একদলীয় শাসন ব্যবস্থা (১৯৭৫)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল ১৯৭৫ সালের মার্চে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয় এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই সিদ্ধান্তটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও স্বাধীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি বড় ধরনের আঘাত হিসেবে দেখা যায়।

  • একদলীয় শাসনের সূচনা: ১৯৭৫ সালের ২৪শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন একটি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে একমাত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেন। এর ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়, এবং গণতন্ত্রের ধারণা ক্ষুণ্ণ হয়।
  • গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার সংকোচন: একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কারণে রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সীমিত হয়ে যায়। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, যেমন বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড, মুক্ত চিন্তা, এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। স্বাধীন সাংবাদিকতা, বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং সাধারণ জনগণের কণ্ঠস্বরও স্তব্ধ হয়ে যায়।

১৯৭৫ সালের সংবিধান সংশোধনী

১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থাকে একদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত করেন। এই সংশোধনীতে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী কার্যকর করা হয়, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই সংশোধনী একই সাথে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি—বহুদলীয় ব্যবস্থা এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা—কে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন

বঙ্গবন্ধু শাসনকালে বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৫ সালের পর, রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রায় সীমিত হয়ে যায়। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং গ্রেফতার, অত্যাচার, নির্যাতন চালানো হয়। এই সময়কার ঘটনাগুলি গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিকৃতি

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, যা ছিল একটি গণতান্ত্রিক, মুক্ত, এবং সমতার ভিত্তিতে গড়ে তোলার আন্দোলন। কিন্তু, ১৯৭৫ সালের মার্চে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি এক ধরনের বিতর্কিত আঘাত আসে। বঙ্গবন্ধু নিজেই একজন মুক্তিযুদ্ধের নেতা হলেও, তার শাসনামলে দেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত এমন এক দিক থেকে গড়ে ওঠে, যা মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক এবং মুক্তির আদর্শের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল না

পত্রিকা ও গণমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা

বঙ্গবন্ধু শাসনামলে মুক্ত সংবাদ মাধ্যমের ওপরও কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বিরোধী মতামত প্রকাশের সুযোগ ছিল না এবং সংবাদপত্রগুলোকে সরকারের ইচ্ছার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করতে বাধ্য করা হত। ১৯৭৫ সালে পুনঃসংশোধিত সংবিধান এবং শাসকগোষ্ঠী এই সময়ের মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পায়।

অপরাধী দমন ও জনগণের অধিকার

বঙ্গবন্ধুর সময়কালেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকাংশে অস্থিতিশীল ছিল। বিশেষ করে যুদ্ধপরবর্তী সময়ের অসংখ্য অপরাধী দমন ও পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া ছিল একদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, অন্যদিকে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনও ঘটেছিল। এমনকি কেবল রাজনৈতিক বিরোধিতা করা বা সরকার বিরোধী মনোভাব পোষণ করলেই অনেক সময় নির্যাতন বা গ্রেফতার হতে হতো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল, বিশেষত ১৯৭৫ সালের পর, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার প্রতি এক ধরনের খোঁচা বা আঘাত হিসেবে দেখা যায়। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ এবং নাগরিক অধিকার হরণ—এসব বিষয়গুলি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী ছিল। যদিও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিসীম অবদান রেখেছিলেন, তার কিছু পদক্ষেপ পরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথকে বিপথগামী করে তুলেছিল।

শাসন ব্যবস্থা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে শাসন ব্যবস্থা ছিল একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল অধ্যায়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং পরবর্তীতে গঠনমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসন ব্যবস্থা মূলত তিনটি প্রধান পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়:

স্বাধীনতার পর (১৯৭১-৭২):

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ ছিল অস্থিতিশীল এবং অর্থনৈতিকভাবে সংকটাপন্ন, তাই বঙ্গবন্ধু একটি শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস নেন। এর মধ্যে ছিল:

  • ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন:
    বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয় ১৯৭২ সালে, যা দেশের আইনি কাঠামো স্থাপন করে এবং একটি গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এই সংবিধান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল আদর্শের প্রতিফলন এবং প্রাথমিকভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ছিল।
  • সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্ব: সংবিধানে “জনগণের সার্বভৌমত্ব” ঘোষণা করা হয়েছিল এবং জনগণকে ক্ষমতার মালিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
  • বহুদলীয় ব্যবস্থা: সংবিধান অনুযায়ী, দেশের রাজনৈতিক দলগুলির স্বাধীন কার্যক্রমের সুযোগ ছিল।
  • শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার:
    বঙ্গবন্ধু শাসনকালে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে ক্ষমতা প্রধানত প্রধানমন্ত্রী (বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন) এবং তার মন্ত্রিসভার হাতে ছিল।
  • পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসন:
    মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি মূলত শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প ও কৃষি খাতে সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেন। এর মধ্যে ছিল জাতীয়করণ এবং মৌলিক অবকাঠামো উন্নয়ন

একদলীয় শাসন ব্যবস্থা (১৯৭৫):

১৯৭৫ সালের মার্চে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়লে এবং বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদের মুখে বঙ্গবন্ধু একটি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। এই পরিবর্তনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর শাসন ব্যবস্থার সবচেয়ে বিতর্কিত দিক।

  • সংবিধান সংশোধন:
    ১৯৭৫ সালের মার্চে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধন এনে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-কে একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সময় সংসদেও কেবল আওয়ামী লীগের সদস্যরা ছিলেন।
  • গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্বলতা:
    একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অধীনে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত হয়ে যায়, এবং রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন করা হয়। বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার বা অত্যাচারের শিকার হতে হয়, যার ফলে দেশ একটি আধিকারিক শাসন ব্যবস্থায় পরিণত হয়।
  • ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ:
    বঙ্গবন্ধু ক্ষমতাকে তার হাতে কেন্দ্রীভূত করেন এবং রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তে তার ব্যক্তিগত উপস্থিতি ও নির্দেশনা প্রয়োজন ছিল।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও সামরিক শাসন (১৯৭৫):

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক অভ্যুত্থানে হত্যা করা হয়, এবং এর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাজনৈতিক গঠনমূলক পরিবর্তন ঘটে। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়।

সার্বিক চিত্র:

  • স্বাধীনতার পর: বঙ্গবন্ধু প্রথমে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অনুযায়ী সমাজতন্ত্র ও সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
  • একদলীয় শাসন (১৯৭৫): পরবর্তীতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী লীগকে একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে, এটি গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত হিসেবে দেখা যায় এবং বিরোধী দলের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার সীমিত হয়ে যায়।
  • ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: বঙ্গবন্ধু নিজের নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে, রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের অধিকাংশ সিদ্ধান্তে নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে রেখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন ব্যবস্থা ছিল একদিকে একটি স্বাধীন, মুক্ত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, অন্যদিকে কিছু নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। তার শাসনামলে দেশ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও, পরবর্তীতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রের ধারাকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন।

পরবর্তী প্রভাব:

বঙ্গবন্ধুর শাসন ব্যবস্থার এই পরিবর্তন বাংলাদেশে বেশ বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠেছিল। অনেকেই এটি সমর্থন করলেও অনেকে এটিকে গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত হিসেবে দেখতেন। এরপর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর, দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এক নতুন পর্বের সূচনা হয়, এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা অনেকটা বিলীন হয়ে যায়।

এভাবেই বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসন ব্যবস্থা একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ছিল, যা ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে যায়।