বিশ্ব নির্বাচন ব্যবস্থা ও আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তকে এখন আর দুরের কোন সীমানা বলে মনে করা হয় না। কারণ পৃথিবীকে এখন গ্লোবাল ভিলেজ বলা হয়ে থাকে। এই বলার কারণ হল এখন পৃথিবীর এক প্রান্তে কখন কি হচ্ছে তা খুব দ্রুততর সময়ে অন্য প্রান্তের দেশ ও মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।

পৃথিবীতে এখন নামধারী হলেও গণতন্ত্র নামক শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত দেশের সংখ্যাই বেশি। যদিও গণতন্ত্রের আসল যে সংজ্ঞা সে অনুযায়ী গণতন্ত্র সত্যি সত্যি কয়টি দেশে লালন ও পালন করা হয় সেটা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ বির্তক করাই যায়। গণতন্ত্রের কথা শুধু মুখে বললেই হয় না গণতন্ত্রকে লালন ও পালন করতে হয়। গণতন্ত্রকে মানতে হলে হারতে জানতে হয়, গণতন্ত্রকে জানতে হলে বিপক্ষ শক্তিকে সম্মান দিতে হয়, গণগন্ত্রের বিকাশ ঘটাতে হলে দেশের জনগণের মতামতের প্রাধান্য দিতে হয় এবং সেই কারণে অনেক সময় বা ক্ষণিকের জন্য হয়তবা সিদ্ধান্ত আপনার পক্ষে নাও যেতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদের জন্য ভাল হবে। গণগন্ত্র মানে এই নয় যে, যে কোন মুল্যে আমাকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে, গণতন্ত্র মানে এটা নয় যে, আমার বা আমাদের বিকল্প নেই, আমি বা আমরা যে কাজ করতে তা আর কেউ পারে না।

কোন দেশের গণতন্ত্রকে যদি সঠিক ভাবে রান করাতে হয় তাহলে সে দেশের কিছু প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে জানতে হয়। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান হলো সেদেশের নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। মাত্র কিছুদিন হলো এই তো অল্প কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হলো বর্তমান পৃথিবীর গণতন্ত্রের অন্যতম মডেল দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে খেয়াল বা পর্যবেক্ষণ করলে কিছু কিছু বিষয়ে পরিস্কার একটা ধারণ মিলবে আমাদের জনমনে। যারা আমেরিকার নির্বাচনের কিছুটা খোঁজ খবর রেখেছেন তারা অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন যে তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট কিন্তু নানাভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে তথা নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে কিন্তু শেষমেষ তা করতে পারেনি। পারেনি এই কারণে যে, সেই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা দেশের জন্য দায়িত্ব পালন করে তারা কোন ব্যাক্তির অর্পিত দায়িত্ব পালন করে না। তারা পালন করার চেষ্টা করে সেই দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যে বা যারা দিবে সেই সঠিক ব্যাক্তিকে দেশের জনগণ নিবিঘ্নে, নিশ্চিন্তে ও নিরপেক্ষভাবে বেছে নিতে পারে তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করা। তারা দেখায় দেশের প্রতি আনুগত্য কোন ব্যাক্তি বা দলের প্রতি বিন্দু মাত্র দুর্বলতা তারা দেখায় না।

গণতন্ত্রের অনেক বড় সৌন্দর্য হল অনেক সময় সবচেয়ে যোগ্য ব্যাক্তিটি নির্বাচিত নাও হতে পারে তবে তাকে কোনভাবেই অসম্মান ও অসহযোগিতা করা যাবে না দেশ ও জাতির স্বার্থে কারণ দেশের সাধারণ জনগণ একবার ভূল করতে পারে বার বার কিন্তু সে ভুল করবে না। আর ভূলকে ভুল দিয়ে মোকাবেলা করা গণতন্ত্রের শিক্ষা নয়। ভুলকে সঠিকভাবে সঠিক রাস্তা দেখানো গণতেন্ত্রের আসল শিক্ষা। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সমালোচনাকে সহ্য করা শিখতে হবে। সামালোচককে যদি শত্রু মনে করি তাহলে আমার কোন কাজটি ভাল হচ্ছে দেশের জন্য আর কোন কাজটি দেশের জন্য ভাল হচ্ছে না তা কিন্তু আমি বুঝতে পারব না। তবে সমালোচনা যারা করবেন তাদের ও মনে রাখতে হবে সমালোচনা যেন গঠনমুলক হয়, সমালোচনা করার বিষয়কে সমালোচনা করতে হবে। আবার ভাল কাজের প্রশংসা করতে হবে তবে ভাল কাজের উৎসাহ  বাড়বে ভাল কাজের প্রশংসা করলে কিন্তু কেউ ছোট হয়ে যায় না।

একটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান যে সকল কাজ গুলো করে সে গুলো হলো সময়মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং সময়মতো নির্বাচিত প্রার্থীর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা, নির্বাচনে উভয় পক্ষের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করা, সকল প্রার্থীদেরকে সমহারে প্রচারণার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া, সকল ভোটার যাতে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে তার অতি মুলব্যান ভোটটি নিবিঘ্নে ও নির্ভয়ে প্রদান করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। নির্বাচন কালীন সময়ে যে কোন প্রার্থীর আনীত অভিযোগ সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সুরাহা করা। নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের আরও যে কাজটি নিয়মিত মনিটরিং করা উচিত তা হলো প্রত্যেক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবে প্রার্থী বাছাই হয় কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা। দলীয় গণতন্ত্র যদি সঠিক ভাবে বিকশিত না হয় তাহলে কোন ভাবেই গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হবে না।

পৃথিবীর সকল দেশের মতো আমাদের দেশেও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূন্ন করার জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এক হয়ে কাজ করে। কিন্তু তাদের সকল কাজ সকল সময়ে বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ করে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল গুলো। স্বাধীনতা উত্তর আমাদের দেশে দু একটি নির্বাচন ছাড়া আজ অবধি কোন নির্বাচন কি প্রশ্নের বাহিরে ছিল। কোন নির্বাচনকে আমরা প্রশ্নাতীত ভাবে নিরপেক্ষ বলে মেনে নিয়েছি। আমাদের দেশের নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় শুধু যে দল জিতে সেই দলের জন্য। বাঁকি দল গুলোর কাছে কখনই তা মনে হয় না। এই দায় কাদের যারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত তাদের নাকি যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের।

আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে জড়িত যে সকল প্রতিষ্ঠান আছে তারা কি কখনও সাধারাণ জনগণ তথা দেশের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে তাদের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে নাকি তারা তাদের রক্ষা কর্তাদের খুশি করতে ব্যস্ত থাকে।

অতীতের নির্বাচন নিয়ে নানা জন নানা রকমের মন্তব্য করলেও, একটা বিষয় ছিল লক্ষ্যনীয় তা হল ভোটারদের উপস্থিতি। কিন্তু বর্তমান সময়ের নির্বাচনগুলোর দিকে যদি আপনি খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন এখন কিন্তু আর আগের মতো ভোটার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। যেটাকে আপনি কখনও গণতন্ত্রের জন্য ভাল লক্ষণ বলতে পারবেন না। ভোটারদের উপস্থিতি কম হলে গণতন্ত্রের ধারা হয়ত নষ্ট হয় না ঠিকই কিন্তু গণতন্ত্রের সৌন্দর্য কি টিকে থাকে। আর এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে কিন্তু একদিন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মুখ থুবরে পড়বে। অগণতান্ত্রিক শক্তি গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে হয়তবা।

আপনি কখনই কোন কাজ 100% সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে করতে পারবেনা। তবে সে কাজটি অধিকাংশের যাতে পছন্দনীয় হয় সেভাবে করতে পারবেন একটু চেষ্টা করলে। আমাদের দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠান গুলো অধিকাংশের চাওয়া পাওয়াকে মুল্যায়ন না করে মুষ্টিমেয়দের চাহিদার মুল্যায়ন করতে বেশি তৎপর। প্রতিটি নির্বাচন এর পর আমদের দেশের নির্বাচনের ব্যবস্থার সাথে জড়িত মহোদয়গণ একই কথা বার বার বলেন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, অংশগ্রহণমুলনক হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কখনও সমস্যা কোথায় তা জানার চেষ্টাও করে না বা সমাধান করা তো দুরের কথা। প্রশ্ন হল যা মানুষ বলে কিছু হলেও তো সত্যি হতেই পারে তো সেই সত্যির পেছনে কি কখনও তারা খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

গণতন্ত্রে যেমন সরকার তার একটি সেটআপ গঠন করে নিয়ে পুরো দেশের শাসন কার্য চালায় তো সেখানে বিরোধী দলের ও কিন্তু দেশের প্রয়োজনে এবং তাদের যারা ভোট দিয়েছে তাদের অধিকার রক্ষা করার স্বার্থে সরকারের ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গঠনমুলক সমালোচনা করার অধিকার আছে। তবে তা অবশ্যই সাংবিধানিকভাবে হতে হবে। দেশের স্বার্থে হতে। সবার আগে দেশ এবং সবার পরেও দেশ।

যা কিছুই করিনা কেন সবকিছুর বিনিময়ে যদি দেশ ও জাতি ভাল না থাকে তাহলে সেই রাজনীতি করে লাভ কি। সকল কল্যাণকর কাজ দেশ ও জাতির জন্য তবে সেটা তাদের মতামতের ভিত্তিতেই করতে হবে। ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকে চেয়ে নিতে হবে জোর করে নয়।