করোনা ও আমাদের ভাকসিন ব্যবস্থাপনা

করোনা ভাইরাস আমাদের অনেক বিষয়ে নতুন করে অনেক কিছুই ভাবতে শিখিয়েছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে করোনা ভাইরাস নিয়ে যত রকমের আগ্রহ আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে দেখা গেছে অতীতে কোন ভাইরাস নিয়ে বা ভাইরাস সৃষ্ট কোন রোগ নিয়ে এত ধরনের সচেতনতা আমাদের দেশের লোকের মধ্যে দেখা গিয়েছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীতে আরও অনেক প্রকার ভাইরাস আছে বা ভাইরাস সৃষ্ট রোগ আছে তা নিয়ে কিন্তু এত উদ্বিগ্ন মানুষের মধ্যে দেখা যায় নি কখনও। এর অন্যতম কারণ এর প্রচার এবং মিডিয়াতে করোনা ভাইরাস নিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি রকমের প্রচার। আমি করোনা ভাইরাস তথা কোভিড-19কে কোন ভাবেই হালকা ভাবে নিচ্ছি না বা নেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস নিয়ে অতি আগ্রহের কারণে সকলের কাছে একটা বিষয় খুব চাওয়া পাওয়া ছিল তা হল এই ভাইরাসের প্রতিরোধক ব্যবস্থা ও প্রতিকার মূলক ব্যবস্থা আবিস্কার নিয়ে। কোন কোন দেশ ভ্যাকসিন আবিস্কারের চেষ্টা করছে, কোন কোন ভ্যাকসিন বাজারে আগে আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিকারমুলক ব্যবস্থার কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অনেকেই বলেছেন যে এই ভাইরাসের জন্য আলাদা কোন প্রতিকারমুলক ব্যবস্থা নেই প্রতিকারমুলক ব্যবস্থা বলতে যা করতে হবে তা হল লক্ষণ দেখে এর বিপক্ষে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তবে এর পরেও আমাদের দেশের কিছু প্রতিকারমুলক ব্যবস্থা ছিল লক্ষণীয় যা পৃথিবীর অনেক দেশ অনুসরণ করেছে।

ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ ছিল অত্যন্ত বেশি। তারা হয়ত মনে করত যে, ভ্যাকসিন আবিস্কার হওয়ার সাথে সাথেই হয়তবা তারা ভ্যাকসিন পেয়ে যাবে। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো ভ্যাকসিন আবিস্কার হওয়ার পরও এত দ্রুততর সময়ের মধ্যে পৃথিবীর তথা আমাদের দেশের সকল জনগণ ভ্যাকসিনের আওতায় আসবে না। এর পিছনে যে কারণগুলো আছে তা হলো এর প্রাপ্যতা, এর চাহিদা, এর ব্যবস্থাপনা, এর কার্যকারিতা, জণগণের আস্থা এবং সর্বোপরি এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ভ্যকসিন নিয়ে রাজনীতি ইত্যাদি।

1ম ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা ও চাহিদা নিয়ে কিছু কথা বলি, সমগ্র পৃথিবীতে যে পরিমাণ চাহিদা আছে তা কি আগামী দুই বছরেও পূরণ করা সম্ভব বলে মনে হয় না। চাহিদা মত যদি এটি তৈরী করা না যায় তাহলে কিন্তু এর প্রাপ্যতাও নিশ্চিত হবে না। এছাড়াও চাহিদা ও প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে আরও যে বিষয় গুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হলো উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ ও অনুন্নত দেশের কাঠামো। এর পরে যে দেশ গুলো ভ্যাকসিন তৈরী করবে আগে তো তারা চাইবে তাদের নিজেদের চাহিদা মোটামুটি পূরণ করার চেষ্টা করবে তারপরে না তারা অন্যান্যদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করবে। আছে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা সকল দেশের পক্ষে কি ভ্যাকসিন ফ্রি তে দেওয়ার সক্ষমতা আছে কিনা।

2য় যে বিষয় তা হল এর ব্যবস্থাপনা প্রত্যেক দেশের জন্য ভ্যাকসিন ব্যবস্থাাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমাদের দেশের জনগণকে আমরা কিভাবে ভ্যাকসিনের আওতায় আনব সেটা নির্ভর করে আমাদের দূরদর্শিতার উপর। আমরা ভ্যাকসিন এনেছি এবং পেয়েছি তবে এখন যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই ভ্যাকসিন আমরা কোন শ্রেণীর লোকদের আগে প্রয়োগ করব। সেই প্রেক্ষপটে আমরা যে বিষয়টি লক্ষ্য করছি তা হল অন্যান্য দেশের ভ্যাকিসিন ব্যবস্থাপনাার সাথে আমাদের ব্যবস্থাপনার কিছু কিছু অমিল লক্ষ করা যাচ্ছে। আমাদের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ফ্রন্টলাইনার যারা তারা আগে ভ্যাকসিন পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে ফ্রন্টলাইনার কারা। অন্যান্য দেশে ফ্রন্টলাইনার বলতে বোঝায় যে সমস্ত পেশাজীবীর লোকজন এই মহামারি কালীন সময়ে সরাসরি যুক্ত। বর্তমানে সেই বিবেচনায় ফ্রন্টলাইনার বলতে কিন্তু চিকিৎসা পেশায় যারা যুক্ত আছেন তারা এবং প্রশাসনের কিছু বিভাগ যেমন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিক তবে সাংবাদিকের ক্ষেত্রে সকল শ্রেণীর সাংবাদিকদের আমি বিনামুল্যে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার পক্ষপাতি নই কারণ হলো সকল সাংবাদিক কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষে সাংবাদিকতা করে না তারা করে কারো ব্যবসায়িক স্বার্থ অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে।  সেই সকল সাংবাদিকদের উচিত তাদের মালিকদের বাধ্য করা যেন তারা তাদের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা। তারা কেন আমাদের কৃষকের ঘাম ভেজানো টাকায় কেনা ভ্যাকসিন এসি লাগানো অফিসে বসে থেকে গ্রহণ করবে। আমি শুধু তাদের কথা বলব না আমি সকলের উদ্দেশ্যই বলছি কোন সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠানের চাকুরীজীবী বাদে কোন চাকুরীজীবীদেরই ফ্রি ভ্যাকসিনের আওতায় আনা উচিত হবে না। সরকারী চাকুরীজীবিদের ফ্রি ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যেতে পারে কেবল মাত্র 3য় ও 4র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের। সকল বেসসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরতদের উচিত তাদের প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা তাদের জন্য ভ্যাকসিনের করতে প্রয়োজনে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করা।

আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ প্রায় 1 বছর হতে চলল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে খেলা যায় সেই দিকে কোন প্রকার নজর কারও নেই। আমদের কি উচিত নয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভ্যাকসিনের আওতায় এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার ব্যবস্থা করা হয়ত বলবেন 18 বছরের নিচে তো ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না। কিন্তু সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীই কি 18 বছরের নিচে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরাতো আর 18 বছরের নীচে নয়। যে সকল শিক্ষার্থীর বয়স 18 বছরের উপরে তাদের এবং সেই সকল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক কর্মচারীদের ফ্রি ভ্যাকসিনের আওতায় এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যদি প্রয়োজন হয় শিক্ষকদের কাছ থেকেও ভ্যাকসিনের দাম নেওয়া যেতে পারে তবে শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীদের অবশ্যেই ফ্রিতে ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত। আমরা কি সেদিকে যাচ্ছি। যতদুর জানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য ভ্যাকসিন দেওয়ার যে পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে তা প্রায় 2য় ধাপে। তাহলে কি এই সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধই থাকেবে না খেলা থাকবে। আর যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং তার ফলে যদি সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায় তাহলে এর দায়িত্ব কে নিবে।

ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার আর  একটি বিশেষ দিক হল এর বিতরণ ব্যবস্থা। ভ্যাকসিনের বিতরণ যদি আমরা ঠিকমত করতে না পারি ভ্যাকসিনের বিতরণ যদি সকল জনগণের মাঝে সমপরিমাণে না করতে পারি তাহলে কি এর সুফল পাওয়া যাবে। যার বেশি প্রয়োজন সে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে পাবে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু এদেশের সরকারের। ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনায় শুধু সমাজের এলিট শ্রেণীর লোকজনদের নিয়ে করলেই হবে না আমাদের দেশের প্রান্তিক লেভেলের কৃষকদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এদেশের কৃষকদের যদি আমরা সুস্থ রাখতে না পারি তাহলে  তাহলে আমাদের মাঠে ফসল ফলাবে কে।

আমাদের দেশের ছিন্নমুল মানুষকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে তাদের কি করে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যায়। দেশের প্রান্তিক লেভেলের মানুষকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে যদি তা না করে যদি দেশের ভিআইপিদের নিয়েই পরিকল্পনা করি তাহলে সাধারণ মানুষ কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা নিয়েই প্রশ্ন তুলবে।

ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার আর একটি দিক হলো এর প্রচার। সঠিক ও সময়মতো এর প্রচার সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি না করা যায় তাহলে ভ্যাকসিন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সঠিক তথ্য জানতে পারবে না।

আমাদের সাধারণ যুব সমাজকে কখন কিভাবে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হবে তার সঠিক সুচিন্তিত পরিকল্পনা থাকাটা জরুরী।

ভ্যাকসিন পৃথিবীতে তথা আমাদের দেশে আনা হচ্ছে আমাদের দেশের জনগণের উপকারের জন্য এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই এই ভ্যাকসিন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অহেতুক ভীতির সঞ্চার করা সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝানো এটা কোনভাবেই সভ্যতার পর্যায়ে পড়েনা। রাজনীতি করার জন্য মানুষের দরকার আছে তাই যে কোন মুল্যে সেই মানুষকে ভাল রাখার দায়িত্ব আমাদের আমাদের দেশের সরকারের যেমন আছে তেমনি আছে সরকারের বাহিরে যে সমস্ত দল তাদেরও। যে কোন নতুন সৃষ্টিতে নানা প্রকার উন্নয়নযোগ্য দিক থাকবে তাই বলে তাকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে তার আরও বেশি উন্নয়ন করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।

পরিশেষে বলতে চাই যে, সঠিক ও সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেকের প্রয়োজনীয় জিনিস কে অল্পজনের মাঝে সুন্দরভাব বিতরণ করা যায়। কিন্তু তার জন্য থাকা চাই সুন্দর মানসিকতা।