দেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরেই বাড়িভাড়া, চিকিৎসা সহায়তা এবং শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা বৃদ্ধির মতো মৌলিক দাবিগুলো বাস্তবায়নের আশায় দিন গুনছেন। এটি কোনো বাড়তি সুবিধা নয়—বরং শিক্ষক সমাজের ন্যায্য অধিকার, যা তাদের সম্মানজনক জীবনযাপন এবং মানসিক-শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে অপরিহার্য। কিন্তু এ দাবিগুলো বছরের পর বছর ধরে কেবল ফাইলের পর ফাইল ঠেলেই চলছে, সিদ্ধান্তের স্তরে পৌঁছানোর আগেই তা হারিয়ে যায় আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি ও প্রশাসনিক অবহেলার চক্রে।
বর্তমানে যে বাস্তবতা, তাতে করে সেই পুরনো জটিলতাই যেন আবারও ফিরে আসছে নতুন মোড়কে। সরকারের বিদায়ী সময়ে শিক্ষাখাতে কিছু আশাব্যঞ্জক বার্তা দেওয়া হয়েছিল—বিশেষ করে সদ্য বিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বর্তমান পরিকল্পনা উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে উচ্চাশার বাণী শোনানো হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে, সেই প্রতিশ্রুতিগুলো আদৌ কি এই সরকারের মেয়াদের মধ্যেই বাস্তবায়িত হবে? নাকি আগের মতোই আবারও ‘পরবর্তী সময়ে বিবেচনার’ অজুহাতে থেমে থাকবে সব? এ নিয়ে শিক্ষক সমাজে গভীর অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ বিরাজ করছে—যা শুধু হতাশাজনক নয়, বরং শিক্ষাক্ষেত্রের সামগ্রিক গুণগত উন্নয়নেও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
আমলারা প্রায় প্রতিবারই নতুন কোনো ‘কার্যক্রম’ সামনে এনে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায্য দাবিগুলোকে পিছিয়ে রাখেন। বর্তমানেও একই চিত্র। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথমে ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোকে এমপিওভুক্ত করার কাজটি সম্পন্ন করা হবে। যদিও এই বিষয়ে নীতিমালা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, বাস্তবতা হলো—এটি কোনো ১৫ দিন বা এক মাসের কাজ নয়। এরপর তারা নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তকরণের কাজে মনোযোগ দেবেন, যেটিও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। সর্বশেষে যদি সময় মেলে, তখন বিবেচনায় আসবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি। বাস্তবে এটি অনেকটাই যেন ‘ছেলেভোলানো’ আশ্বাসের মতো শোনায়।
এই আশ্বাসের ধরন দেখে একধরনের বিষয় স্পষ্ট বোঝা যায়—এমপিওভুক্তদের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও বিনোদন ভাতা বৃদ্ধি তাদের অগ্রাধিকার নয়। যদি সত্যিকার অর্থেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হতো, তাহলে অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি সমান্তরালভাবে এই ভাতাগুলো নিয়েও পরিকল্পনা করা যেত। এমনকি সরকার চাইলে একটি সময়সীমা ঘোষণা দিয়েও জানাতে পারত—ফলান তারিখ থেকে এ পরিমাণ হারে ভাতা কার্যকর হবে। তাতে শিক্ষক সমাজ অন্তত নিশ্চিত হতে পারত তাদের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একটি সহজ ও যৌক্তিক দাবিকেও আমলারা অকারণ জটিলতার আবরণে জড়িয়ে রাখছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানে প্রশাসনে থাকা অনেক আমলা অতীতের অগণতান্ত্রিক সরকারের সময়কার চিন্তাচেতনা ও আচরণ বহন করে চলেছেন। ফলে তারা কখনওই চান না, একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার সহজ কোনো সিদ্ধান্ত সহজভাবে বাস্তবায়ন করুক। বরং বিলম্ব ও বিভ্রান্তি তৈরিই যেন তাদের মূল উদ্দেশ্য। অথচ শিক্ষা খাতকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষক সমাজের স্বাভাবিক প্রশ্ন—প্রথমে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তকরণ, তারপর নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তারপর যদি সময় মেলে তবে আমাদের ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় আসবে! তাহলে কি শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনাগুলো কেবল প্রতিশ্রুতির ফাঁদেই আটকে থাকবে? অথচ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা এবং শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অনেক আগেই নীতিগতভাবে অনুমোদিত হওয়ার কথা ছিল। বাস্তবচিত্র হলো, এসব দাবির বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই। আমলারা বিষয়টিকে যেন গুরুত্ব দেওয়ার মতো কিছুই মনে করছেন না। বরং তারা বরাবরই শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকারকে গৌণ করে দেখার এক অপসংস্কৃতি চর্চা করে আসছেন।
দুঃখজনকভাবে, এসব আমলা যেন নিয়োজিত হয়েছেন শিক্ষক সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবমূল্যায়ন ও হেয় প্রতিপন্ন করার একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়ায়। তারা এখন ব্যস্ত ‘শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সিডিউল’ তৈরিতে—যেখানে তারা সুবিধাভোগী হওয়ার সুযোগ দেখছেন। সেই একই শিক্ষকদের ভাতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণে তাদের সময় বা আগ্রহ কোনোটিই দেখা যাচ্ছে না। কারণ এ কার্যক্রমে তাদের প্রত্যক্ষ কোনো লাভ নেই বলেই তারা মনে করেন।
যদি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তাদের ‘অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজ’ চলে, তবে বাস্তবতা হলো—ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি অক্টোবরের আগে বিবেচনাতেও আসবে না। আর অক্টোবরেই যদি কোনো কার্যক্রম শুরু হয়, তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, তা বাস্তবায়নে কয়েক মাস লেগে যাবে। সরকার যেহেতু ইতোমধ্যেই মেয়াদের শেষ প্রান্তে, তাই এর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার এসে পড়বে এবং পূর্বসূরিদের মতোই আবার বলা হবে—“পরবর্তী সরকারের জন্য অপেক্ষা করুন।” অর্থাৎ শিক্ষক সমাজের ভাগ্যে নেমে আসবে আরেক দফা প্রতারণা ও নিরাশা।
এই অবস্থার পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর। শিক্ষক সমাজের আর্থিক ও মানসিক অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। পেশার প্রতি আকর্ষণ কমছে, তরুণ ও যোগ্য ব্যক্তিরা শিক্ষা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এর ফলশ্রুতিতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম মানসিক ও কাঠামোগত ক্ষয় নেমে আসছে।
শিক্ষা মানেই শুধু পাঠ্যসূচি নয়—এটি একটি পেশা, যেখানে টেকসই পরিবেশ, সম্মান, নিরাপত্তা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। এই কাঠামো শক্তিশালী না হলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাড়িভাড়া, চিকিৎসা এবং শ্রান্তি ভাতাসহ অন্যান্য ন্যায্য সুবিধা বৃদ্ধি কোনো ‘অবসরে ভাবার বিষয়’ নয়—এটি এখনই বাস্তবায়নের দাবি রাখে।
অতএব, এখন সময় এসেছে ভ্রান্ত আশ্বাসের মায়াজাল থেকে বের হয়ে শিক্ষকদের সংগঠিত হওয়ার। ইতিহাস বলছে, শিক্ষক সমাজ তাদের ন্যায্য অধিকার আন্দোলন ছাড়া কখনোই আদায় করতে পারেনি। তাই এবারও প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামার। কারো মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, নিজের অধিকার আদায়ে, নিজের প্রয়োজনেই আবার সংগঠিত হতে হবে। যে যতদিন চুপ থাকবে, বঞ্চনার শিকার সে ততদিনই হবে। তাই সময় থাকতে প্রস্তুতি নিন—আন্দোলনের জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য।
Leave a Reply