শিক্ষক প্রশিক্ষণ: উপেক্ষিত বাস্তবতা ও আমলাতান্ত্রিক চক্রের বেড়াজাল
শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম—এ কথা সর্বজনবিদিত। তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য দক্ষতা উন্নয়ন হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বরং এর পেছনে বরাদ্দকৃত অর্থ কিভাবে অপচয় বা আত্মসাৎ করা যায়, সে চেষ্টাই যেন অনেক সময় মুখ্য হয়ে ওঠে।
আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোয় নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে একটি বড় ফাঁক রয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ। আমলারা মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা না জেনেই ‘ফাইলনির্ভর’ প্রস্তাব তৈরি করেন। ফলে বছরজুড়ে গুটিকয়েক দিনব্যাপী লোকদেখানো প্রশিক্ষণ আয়োজন হয়, যেগুলোতে নেই মানসম্মত প্রশিক্ষক, নেই যথাযথ পরিবেশ। প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ নিয়ে বেশি আগ্রহী হলেও প্রশিক্ষণের গুণগত মানের প্রতি তাদের মনোযোগ প্রায়শই অনুপস্থিত।
উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষণগুলোতে অনেক সময় দেখা যায়—কাগজে-কলমে বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের সম্মানী কিংবা খাদ্য-ব্যবস্থাপনার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। নানা অজুহাতে সম্মানী বিলম্বিত করা হয়। প্রশিক্ষণের বাজেট থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় একটি অদৃশ্য লুটপাটের সংস্কৃতি বিরাজমান।
উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ট্রেনিং কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যে প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় তা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে। কারণ উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যে কিভাবে কোন ক্রাইটেরিয়া মেইনটেন্ট করে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিবেচনা করা হয় তা শুধু উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাগণই বলতে পারবেন।
আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, অনেক আমলাই এখনো শিক্ষককে সহযোগী পেশাজীবী না ভেবে অধীনস্থ কর্মী হিসেবে বিবেচনা করেন। এই মানসিকতা থেকেই প্রশিক্ষণে থাকে না গুণগত উপাদান, নেই আধুনিক পেডাগজি, ডিজিটাল শিক্ষা কিংবা শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক পদ্ধতির সঠিক অনুশীলন। বরং ট্রেনিং সীমাবদ্ধ থাকে কিছু নিয়ম-কানুন বা ফরম্যাট শেখানোর আনুষ্ঠানিকতায়।
শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নেয়া হয়, সেখানে প্রশিক্ষকের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যাদের উপর প্রশিক্ষণার্থীদের আস্থা নেই, তারাই প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন, যা পুরো উদ্যোগকে অর্থহীন করে তোলে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এ সমস্যার মূল কারণগুলো সকলের জানা সত্ত্বেও নীতিনির্ধারক মহলে নেই কার্যকর উদ্যোগ। আমলারা ‘ট্রেনিং’কে ঝামেলা মনে করলেও এর অর্থ বরাদ্দকে ‘আর্শীবাদ’ ভাবেন। এতে করে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন নয়, বরং ব্যক্তি স্বার্থই হয়ে ওঠে মুখ্য।
শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে প্রশিক্ষণকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নয়, বরং কৌশলগত ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত ও মানবিক উন্নয়ন নিশ্চিত না করে শিক্ষার উন্নয়ন আশা করা বোকামি। কারণ, দিন শেষে শিক্ষার বাস্তবায়ন হয় ক্লাসরুমে, যেখানে কোনো দামী গাড়ি চড়ে আসা আমলা নেই—আছেন শুধু হতাশায় জর্জরিত একদল শিক্ষক।
তাই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ের শিক্ষকদের মতামত এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়াই হবে অধিকতর যৌক্তিক ও টেকসই একটি পথ।
Leave a Reply