ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় তথ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। সেই লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “ইএমআইএস সেল”—Education Management Information System। বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারীদের সকল তথ্য একক প্ল্যাটফর্মে এনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। হাজার হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর অভিজ্ঞতা বলছে, এই সেল এখন আর্থিক হয়রানি, মানসিক চাপ এবং অনিশ্চয়তার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। ইআইএমএস সেল হয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে এক আতঙ্কের নাম। কারণে অকারণে শিক্ষকদের হয়রানি করা ইএমআইসেলের নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইএমআইএস-এর তথাকথিত হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের বেতন আটকে থাকার ঘটনা এখন নিত্যদিনের। সামান্য একটি বানান ভুল, জন্মতারিখের অসামঞ্জস্যতা, বা জাতীয় পরিচয়পত্রের অমিলের অজুহাতে একাধিক মাস ধরে একজন শিক্ষককে বেতনবিহীন জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এটা কি কেবল সফটওয়্যার সমস্যা, না কি ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিকভাবে জর্জরিত রাখার একটি ‘প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল’? অথচ এই ইএমআইএস সেল কিন্তু সকল প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে প্রতিবছর ডাটা আপডেটের নাম করে সকল শিক্ষক কর্মচারীর সকল তথ্য নেয়। সেগুলো কেন নেয় যদি সেগুলো প্রয়োজনে কাজে না লাগে।
শিক্ষক সমাজ আজ প্রশ্ন তুলছে—ইএমআইএস সেল কি তথ্য ব্যবস্থাপনার সেল, না কি আর্থিক নিপীড়নের কারখানা? একদিকে শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য পদে পদে আবেদন, সুপারিশ, ভিজিট—অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততা ও জবাবহীনতা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নামে যে হয়রানির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা এক ধরনের প্রশাসনিক নিপীড়নের রূপ নিচ্ছে।
একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, চাকরিগত ও ব্যাংক সংক্রান্ত অসংখ্য তথ্য আবারও পুনঃনিবন্ধনের নামে চাওয়া হচ্ছে। অথচ, এসব তথ্য পূর্বেই মাউশির সার্ভারে বিদ্যমান। কেন একই তথ্য বারবার শিক্ষকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কেন এই ‘ডিজিটাল আমলাতন্ত্র’? এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
একজন শিক্ষক যখন মাস শেষে পরিবারের খরচের কথা ভেবে নিজের প্রাপ্য বেতনের জন্য অফিস থেকে অফিসে ঘোরেন, তখন তার আত্মমর্যাদা কোথায় থাকে? শিক্ষা ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিকে এমনভাবে দাসত্বের দিকে ঠেলে দেওয়ার নৈতিক অধিকার মাউশির বা ইএমআইএস সেলের নেই।
এখন সময় এসেছে এই অব্যবস্থাপনার দায় নির্দিষ্ট করার। কোনো একটি দপ্তর কি ইচ্ছাকৃতভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে? না কি উপরের মহলে এমন কিছু গোষ্ঠী সক্রিয়, যারা শিক্ষকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আর্থিক সুবিধা হাসিল করছে? তদন্ত ও জবাবদিহিতা ছাড়া এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন প্রদানের জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার পুর্বের অ্যানালগ সিষ্টেমের বেতন প্রদানের কার্যক্রম থেকে বের হয়ে সরকারী চাকুরীজীবিদের ন্যায় ইএফটিতে বেতন প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করে মাউশিকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ থাকার পরও এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের ইএফটিতে বেতন প্রদানের কার্যকরী ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করেনি মাউশি তথা মাউশির ইএমআইএস সেল। প্রতি মাসে নিত্য নতুন সমস্যা নিয়ে হাজির হয় ইএমআইএস সেল। তাদের মুল উদ্দেশ্য হলো ইএফটি বাস্তবায়ন না হয়। কারণ এখানে রয়েছে মাউশির অন্য কোন গোপন উদ্দেশ্য।
যদি অবিলম্বে ইএমআইএস ব্যবস্থায় সংস্কার না আনা হয়, শিক্ষকদের হয়রানি বন্ধ না হয়, তাহলে আগামীতে দেশজুড়ে শিক্ষক সমাজকে আরও সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদে নামতে হতে পারে। কালোব্যাজ ধারণ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি—এসব প্রাথমিক পদক্ষেপের পর আন্দোলনের পথও উন্মুক্ত থাকবে। যে কোন মানুষ বা যে কোন পেশাজীবি কিন্তু একদিনের বিদ্রোহী হয় না যখন দেখে তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে আর ও কোন উপায় নেই তখন কিন্তু সে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। তাই তো বলি এখনও সময় রয়েছে…..
পরিশেষে যা বলতে চাই তা হলো- মাউশির ইএমআইএস সেল একটি সম্ভাবনাময় ডিজিটাল উদ্যোগ ছিল, কিন্তু আজ তা শিক্ষকদের জন্য হয়ে উঠেছে বিভীষিকা। এই সেলকে যদি সত্যিকার অর্থে শিক্ষকবান্ধব না করা যায়, তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এই প্রচেষ্টা নিজের ভারেই ধসে পড়বে। শিক্ষক সমাজকে অবজ্ঞা করে কোনো উন্নয়নই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
আন্দোলন হওয়া দরকার