শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, আর শিক্ষকরাই সেই মেরুদণ্ড সচল রাখেন। কিন্তু বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও ব্যবস্থাপনাগত জটিলতা ক্রমাগত এই মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে তুলছে। বেতন-ভাতা বিলম্ব, ইএফটি সিস্টেমের ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়ন, বৈষম্যমূলক নীতি, এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা শিক্ষকদের দৈনন্দিন জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। এই সমস্যাগুলো শুধু আর্থিক নয়, এটি শিক্ষার গুণগত মান ও জাতির ভবিষ্যতের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
দেশের প্রায় ৩.৯৮ লাখ এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ৩.৮৫ লাখেরও বেশি শিক্ষক ডিসেম্বর ২০২৪ মাসের বেতন-ভাতা পেয়েছেন। অর্থাৎ প্রায় ১০ হাজারের অধিক শিক্ষক এখনও ডিসেম্বর ২০২৫মাসের বেতন পাননি। বেতন ইএফটি পদ্ধতিতে দেওয়া হলেও তথ্য যাচাইকরণে নানা সমস্যার কারণে এই বিলম্ব দেখা দিয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ইএমআইএস সেল জানায়, অনেক শিক্ষকের ডাবল এমপিও বা ভুল তথ্যদানের কারণে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে তথ্য মিলছে না। এসব কারণে ইতোমধ্যেই ডিসেম্বরের বেতন পরিশোধ কার্যক্রম কয়েক দফায় পিছানো হয়েছে। সর্বশেষ বলা হয়েছিল মে মাসের শুরুতেই তাদের ইএফটির আওতাভুক্ত করে পর্যায়ক্রমে তাদের বেতন পরিশোধ করা হবে কিন্তু এখন অবধি সেই কার্যক্রম আলোর মুখ দেখেনি। এখানে প্রশ্ন হলো এই সকল শিক্ষকের কি পরিবার পরিজন নাই। তাদের সেই পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতে হয়না– প্রথম ধাপে ১ লাখ ৮৯ হাজার, দ্বিতীয় ধাপে ৬৭ হাজার এবং তৃতীয় ধাপে ৮৪ হাজার ৭০০ শিক্ষকের বেতন ইএফটিতে দেওয়া হয়েছে। বাকি শিক্ষকদলের তথ্য হালনাগাদ করে চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। তারা এখন ইএফটির আওতাভুক্ত। কিন্তু বাকি শিক্ষকগণ প্রতিনিয়ত উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এই বিলম্ব শিক্ষকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
এপ্রিল ২০২৫-এর বেতন এখনও পরিশোধ হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে ডিসেম্বর ২০২৫ এর বেতন যে সকল শিক্ষক কর্মচারী পায়নি তাদেরকে সপ্তম ধাপের আওতাভুক্ত করে তাদের বেতনের প্রস্তাব আগামী সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতে পারে। ৭ম ধাপের বেতনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর শুরু হবে এপ্রিল মাসের বেতনের প্রস্তাবও মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কার্যক্রম। অর্থাৎ সরকারি বা মাউশি পক্ষের বক্তব্য, আইনগত প্রক্রিয়া শেষ হলে এপ্রিলের বেতন দ্রুত দেওয়া যাবে। তবে বাস্তবে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক এখনো চিন্তিত। বহু শিক্ষক ও কর্মচারীরা অভিযোগ করছেন যে পদ্ধতিগত টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে আদৌ এপ্রিল বেতন প্রসেসিং শুরুই হয়নি সেই সমস্যা প্রতিমাসে কেন ফিরে ফিরে আসে নাকি নিয়ে আসা হয়। এক শিক্ষক বলেন, “এতদিন বলা হয়েছে তথ্য সঠিক না থাকার কারনে দেরি, এখন বলা হচ্ছে টেকনিক্যাল ইস্যু। আসলে মুল বিষয় হলো অজানা কোন অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিমাসে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন এভাবে দিনের পর দিন বিলম্ব করা হচ্ছে। এদিকে মে মাস শেষের দিকে এগিয়ে আসায় শিক্ষকেরা আশঙ্কা করছেন যে এই বিলম্ব ঈদুল আজহার আগে মে মাসের বেতন-বোনাস পর্যন্ত প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা দাবি করছেন দ্রুত বেতন-ভাতা মুক্তির স্পষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করতে। আর যদি এবারও ঈদের পূর্বে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ও বোনাস নিয়ে টালবাহানা শুরু হয় তাহলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে মাউশির দৃর্ণীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।
সব ধরনের এমপিওভুক্ত শিক্ষকই এখন ইএফটির আওতায় আনার কথা থাকলেও কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিষয়ে আলাদা উদ্বেগ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারের ঘোষণায় সরকারি শিক্ষকদের মতো বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা ইতোমধ্যে ইএফটির মাধ্যমে বেতন পাচ্ছেন, কিন্তু একই পদ্ধতি মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাদ্রাসার শিক্ষকরা। এ প্রসঙ্গে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ. ম. কবিরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন যে, “আগামী এপ্রিলের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্যও ইএফটি চালু করতে কাজ চলছে। দ্রুত এ কাজ শেষ হবে”। অর্থাৎ মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে চলতি এপ্রিলের মধ্যে মাদ্রাসার ইএফটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে মাদ্রাসার ইএফটির কার্যক্রম এখনও শুরুই হয়নি। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষকদের ইএফটির পাইলটিং শুরু করা হলেও তা মুখ থুবরে পড়ে আছে পাইলটিংয়ের আওতায় কিছু শিক্ষক ১ মাসের বেতন পেয়েছেন। ঐ পর্যন্তই তারা এক মাস বেতন পাওয়ার পর পরবর্তী দুইমাস গত হলেও তারা আর কোন এক অজানা কারণে তাদের বেতন বন্ধ হয়ে আছে। কারিগরি স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরাও তাদেরও ইএফটি জটিলতার নিরসনের দাবিতে রয়েছে। অব্যাহত এই ধরনের অবহেলার কারণে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘকালীন দাবির পর গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ একটি বদলি নীতিমালা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। কিন্তু প্রাথমিক সংস্করণে নীতিমালাটি শুধুমাত্র এনটিআরসিএ’র সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদেরই বদলির সুযোগ দিচ্ছে। সুপারিশের বাইরে থাকা অসংখ্য শিক্ষক এই সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করছেন। শিক্ষক সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন যে এতে শিক্ষক সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। যেমন এক অভিজ্ঞ শিক্ষক লিখেছেন, “নীতিমালাটিতে চরম বৈষম্য করা হয়েছে… শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন লক্ষ্য করা যাচ্ছে”। বিকল্প হিসেবে শিক্ষক নেতারা দাবি করেছেন যে সংশোধিত নীতিমালায় সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সর্বজনীন বদলির বিধান আনা উচিত। বর্তমানে বৈষম্যমূলক বদলি নীতিমালা বাতিল করে সার্বজনীন ব্যবস্থা না নিলে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ আরও বাড়তে পারে।
সরকারি ভর্তুকিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা যেসব সুবিধা পাচ্ছেন, তার তুলনায় এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকরা অনেক কম সুবিধায় সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য। উদাহরণস্বরূপ, একই নীতিমালা ও পাঠ্যক্রমের মাধ্যমেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘরভাড়া ভাতা হিসেবে বেতনের ৪৫–৫০% পেয়ে থাকে, অথচ এমপিওভুক্ত শিক্ষার্থীরা মাত্র ১৫০০ টাকা ফ্ল্যাট হাউজিং ভাতা পান। তদুপরি সরকারি শিক্ষকরা ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকে, আর এমপিওভুক্তরা পান মাত্র ৫০০ টাকা। সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে পারে, কিন্তু বেসরকারি এমপিও ভুক্তদের ক্ষেত্রে অধ্যাপকের উপপর্যায়ে (সহকারী অধ্যাপক) পদেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। এই আর্থিক ও পেশাগত বৈষম্য এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে সঞ্চার করেছে গভীর হতাশা। একটি বিশ্লেষণে তুলে ধরা হয়েছে যে সরকারি পর্যায়ে নানা প্রণোদনা থাকলেও এমপিওভুক্তরা তার বাইরেই এবং উদাসীন বোধ করেন। এরপরেও এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীগণ যৎসামান্য যে সুযোগ সুবিধা পায় সেগুলোও আবার যদি প্রদানের ক্ষেত্রেও বৈষম্যমুলক নীতি গ্রহণ করা হয় সেটা কিভাবে মানা যায়। সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যেখানে ঈদুল আযহার উৎসব ভাতা উঠানোর কার্যক্রম গ্রহণ করছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের একাংশ সেখানে এপ্রিলের বেতন পাওয়ার ব্যাপারে হতাশায় ভুগছে। মে মাসের বেতন ও ঈদুল আযহার বেতন তো তার পরের কথা। পরিশেষে যা বলব তা হলো এই অবহেলা ও বৈষম্য এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কর্মমানসিকতা দুর্বল করছে এবং শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক গতিশীলতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এভাবে আর কতদিন তারা এই বঞ্চনা মেনে নিবে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কিন্তু ঈদুল আযহার ও গ্রীষ্মের ছুটি অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। তখন কিন্তু আমাদের দেশের এই শিক্ষা বিশারদ আমলাদের মনে হয়নি যে, শিক্ষায় শিখন ঘাটতি হচ্ছে, মনে কখন হলো যখন সরকার কর্মকর্তা কর্মচারীদের ঈদের ছুটি কয়েকদিন বাড়িয়ে তার পরিবর্তে ঈদের পূর্বে দুই শনিবার অফিস খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এখানে যে বিষয় নিয়ে প্রশ্নের অবতারণা তার হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়েওনি কমেও নি তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হলো কেন?
সমন্বিতভাবে দেখা যাচ্ছে, ইএফটি বাস্তবায়ন ও বদলি নীতিমালার মতো পদক্ষেপের নামে প্রকৃত প্রয়োজন ও বাস্তব সমস্যা পেছনে পড়ছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সুসংহত পদ্ধতিতে সঠিক সময়ে বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করতে না পারলে চলমান সংকট অব্যাহত থাকবে। পদক্ষেপহীনতা শিক্ষক সমাজে হতাশা ও ক্ষোভ জন্ম দিচ্ছে। তাই এখন শিক্ষক-সমাজ এবং সংশ্লিষ্টরা চাইছেন, সরাসরি এবং গতিশীল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই সকল সমস্যা সমাধান করা হোক।
Leave a Reply