বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা আজ গভীর হতাশা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন পার করছেন। এপ্রিল মাসের বেতন এখনও না পেয়ে অনেকে পরিবার চালানো বা নিত্যপ্রয়োজন মেটানো নিয়ে চিন্তায় আছেন। অথচ সামনে মে মাস, রোজার ঈদ পেরিয়ে কোরবানির ঈদের প্রস্তুতিও প্রায় শুরু হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠে আসে— “এপ্রিলের বেতনই যদি ঝুলে থাকে, তবে মে মাসের বেতন এবং ঈদুল আজহার উৎসব ভাতা কবে পাওয়া যাবে?”
এই প্রশ্নটা আজ হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর হৃদয়ের চিৎকার হয়ে উঠেছে। এটা শুধুই আর্থিক প্রশ্ন নয়— এটা মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও মানবিকতার প্রশ্ন। প্রতিমাসে যদি এভাবে আর্থিক নিশ্চয়তার জায়গা অনিশ্চয়তাপূর্ণ হয় তাহলে মনোবল দিন দিন শন্যের কোঠায় পৌছায়।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাস শেষ হয়ে গেছে। অথচ এখনো (মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত) বেশিরভাগ এমপিওভুক্ত(মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষক কর্মচারীরা এপ্রিলের বেতন পেয়েছেন) শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের এপ্রিলের বেতন পাননি। যে বেতনের ওপর তাঁদের পুরো মাসের দৈনন্দিন খরচ নির্ভর করে, সেই অর্থ সময়মতো হাতে না পেলে জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলিই থাকে অনিশ্চিতঃ
এত কিছুর মাঝেও তাঁরা শ্রেণিকক্ষে যান, পাঠদান করেন, শিক্ষার্থীদের সাথে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমিক অংশগ্রহণ করেন— কারণ এটা কেবল পেশা নয়, দায়িত্ব। কিন্তু প্রশ্ন থাকে— রাষ্ট্র তাঁদের দায়িত্ব কতটা পালন করছে? আমরা যেভাবে এ রাষ্ট্রের দেওয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি তাহলে রাষ্ট্র কেন তার দায়িত্ব পালন করতে এত গড়িমসি করবে। এ রাষ্ট্র কি সারাজীবন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করে যাবে। এদেশের অপরাপর অন্যান্য পেশাজীবিরা যেখানে রাষ্ট্র নিকট থেকে পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক সাপোর্ট পায় সেখানে আমরা কেন এরকম বৈষম্যের শিকার হব প্রতিনিয়ত। এদেশে কোনদিনও এমন বিবেকবান শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে না যেদিন সকল অনিয়ম দুর হবে আর গড়ে উঠবে সমাজের সকল ক্ষেত্রে নিয়মের কঠোর দেয়াল।
যদি এপ্রিলের বেতনই এখনো অনিশ্চিত থাকে, যা পেতে পেতে কমপক্ষে ২০ থেকে ২২ তারিখ হয়ে যাবে তবে মে মাসের বেতন— যা জুনের শুরুতে প্রদানের কথা— তা সময়মতো মিলবে কি না, তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। আর জুনের শুরুতে অর্থাৎ ১ থেকে ২ তারিখের মধ্যে যদি মে মাসের বেতন না পাওয়া যায় তাহলে কিন্তু ঘোর আমানিশার অন্ধকার নেমে আসবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের মাঝে।
২০২৫ সালের কোরবানির ঈদ সম্ভাব্য ৬ বা ৭ জুনে। অর্থাৎ উৎসব ভাতা জুন মাসের শুরুর দিকে অর্থাৎ ১ থেকে ২ তারিখের মধ্যে দেওয়া প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো— উৎসব কিন্তু সরকারি ও এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের জন্য একসাথে শুরু হয়। তাহলে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বেতন ও উৎসব ভাতা তারা সময়মতো পাবে। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দকৃত উৎসব ভাতা নিয়ে প্রতিনিয়ত এমন অনিশ্চয়তা দেখা দিবে, এটা কোন ধরনের নিয়ম। এ নিয়ম আর কতদিন চালু থাকবে। এমনিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দকৃত উৎসব ভাতা যৎসামান্য সেটাও যদি সময়মতো ছাড় না দেওয় না হয়, ব্যাংক যাচাইকরণে দেরি, অথবা তথ্যে অসামঞ্জস্যতা, ইদানিং নতুন সমস্যা আবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে যার নাম দেওয়া টেকনিক্যাল সমস্যা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে দিনের পর দিন হয়রানি করতেই থাকে তাহলে কতদিন এভাবে সকল অন্যায় মেনে নিবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী সমাজ। দিন দিন কিন্তু আমাদের সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। মনে রাখবেন আমরা কিন্তু শিক্ষক আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে যেমন সমাজের উচু তলার মানুষ তৈরী হয় তেমনি তৈরী হয় সমাজের বৈষম্য নিরসন কারী প্রতিবাদী সমাজ। প্রতিবাদের মুলমন্ত্র কিন্তু আমরাই শেখাই। তারমানে প্রতিবাদের ভাষা কিন্তু আমাদের খুব ভালভাবে জানা রয়েছে। আমরা প্রতিবাদ ভাষা সহজে ব্যবহার করি না কারণ এতে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে। তাই বলে এভাবে কতদিন মেনে নেওয়া যায়। এভাবে কতদিন গুমরে গুমরে আমরা পর্দার আড়ালে গিয়ে কান্না করব। সারাজীবনই কি আমাদের উৎসবের সময় উৎসব ভাতা পাওয়ার জন্য অনিশ্চয়তার প্রহর গুনব।
বর্তমানে যে পরিস্থিতি আসতে চলেছে তাতে করে এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের ঈদের বাজার করা, পশু কেনা বা পরিবার নিয়ে মানসিক শান্তিতে ঈদ উদযাপন করা যেন অলীক কল্পনায় পরিণত হতে চলেছে।
পরিশেষে যে কথা বলব তা হলো দয়া করে আমাদের নিয়ে এভাবে খেলা করা বন্ধ করুন। আজ শিক্ষক সমাজের কণ্ঠে একটাই ধ্বনি—
“আমরা রাজপথ চাই না, আমরা কেবল সম্মান চাই। আমরা লড়াই চাই না, কেবল সময়মতো বেতন ও উৎসব ভাতা চাই।”
একটি রাষ্ট্র যদি তার শিক্ষকদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে সেটি আসলে তার ভবিষ্যৎ নির্মাণেই ব্যর্থ হচ্ছে।
আজ প্রয়োজন দ্রুত সিদ্ধান্ত, সময়মতো বরাদ্দ, এবং সর্বোপরি একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
Leave a Reply