বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এমপিওভুক্ত (মাসিক পেমেন্ট অর্ডার) শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব একটি গুরুতর সমস্যা, যা তাদের দাবিদাওয়া আদায়কে দীর্ঘমেয়াদে জটিল এবং বাধাগ্রস্ত করে তুলছে। এই সমস্যাটি গভীরভাবে অনুধাবন করা জরুরি, কারণ এটি শুধু শিক্ষকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নয়, বরং সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উপরও প্রভাব ফেলে।
১. ঐক্যের অভাবের মূল কারণ
(ক) শিক্ষকদের বৈচিত্র্য ও পার্থক্য
- প্রতিষ্ঠানের ভিন্নতা:
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান) কাজ করেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ ও প্রয়োজন আলাদা।
- গ্রামীণ বনাম শহুরে পার্থক্য:
গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সাধারণত অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার অভাব নিয়ে বেশি চিন্তিত, যেখানে শহুরে শিক্ষকদের মূল সমস্যা বেতন এবং পেনশন।
- স্তরভেদ:
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রয়োজন এবং চাহিদাগুলো উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের থেকে আলাদা।
- ব্যক্তিগত চাহিদা ও অগ্রাধিকার:
শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত জীবনে ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা থাকে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ পদোন্নতির জন্য সচেষ্ট, কেউ আবার শুধুমাত্র বেতন ও ভাতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী।
(খ) সংগঠনের বিভাজন
- বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিযোগিতা:
দেশে অনেক শিক্ষক সংগঠন রয়েছে, এবং তারা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে।
- সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বা আঞ্চলিক এজেন্ডা অনুসরণ করে, যা শিক্ষকদের সম্মিলিত উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করে।
- কিছু সংগঠন সরকারঘনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে, যেখানে অন্যরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়।
- রাজনৈতিক প্রভাব:
অধিকাংশ শিক্ষক সংগঠন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে তাদের অগ্রাধিকার এবং কার্যক্রমে পার্থক্য তৈরি হয়।
(গ) নেতৃত্বের সংকট
- দুর্বল নেতৃত্ব:
অনেক সময় সংগঠনের নেতারা শিক্ষকদের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের চেয়ে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক লাভে বেশি মনোযোগী হন।
- বিশ্বাসের অভাব:
শিক্ষকরা অনেক সময় তাদের নেতাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না, কারণ তারা আশঙ্কা করেন যে তাদের দাবিগুলো উপেক্ষা করে নেতারা ব্যক্তিগত সুবিধা নেবেন।
(ঘ) চাপ ও ভয়ভীতি
- প্রশাসনিক চাপ:
অনেক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি বা স্থানীয় শিক্ষা অফিস থেকে আন্দোলন বন্ধ করতে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
- চাকরি হারানোর ভয়:
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা অনেক সময় ভয়ে আন্দোলনে যোগ দেন না, কারণ তারা চাকরির অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে চান না।
(ঙ) সচেতনতার অভাব
- অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা:
কিছু শিক্ষক তাদের ন্যায্য অধিকার ও সুবিধা সম্পর্কে সচেতন নন।
- দাবির প্রাসঙ্গিকতা বোঝার ঘাটতি:
অনেক সময় শিক্ষকেরা একত্রিত হয়ে কোন দাবিকে প্রাধান্য দেবেন তা ঠিক করতে পারেন না।
২. ঐক্যের অভাবের ফলাফল
(ক) দাবি আদায়ে ব্যর্থতা
- বিভিন্ন দাবির জন্য শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্যের অভাব থাকায় তারা শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন।
- সরকার বা প্রশাসন শিক্ষকদের আন্দোলনকে গুরুত্ব সহকারে নেয় না, কারণ তারা জানে ঐক্যের অভাবের কারণে আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
(খ) শিক্ষাক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব
- শিক্ষকদের আর্থিক ও পেশাগত সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় শিক্ষাদানের মান হ্রাস পায়।
- প্রতিভাবান শিক্ষকরা অন্য পেশায় চলে যান, ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষতার সংকট দেখা দেয়।
(গ) শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা
- বারবার ব্যর্থতার কারণে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা এবং কাজের আগ্রহ কমে যায়।
৩. ঐক্যের অভাব দূর করার উপায়
(ক) একক প্ল্যাটফর্ম তৈরি
- বিভিন্ন সংগঠনকে একত্রিত করে একটি সর্বজনীন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে।
- এই প্ল্যাটফর্মটি নিরপেক্ষ এবং অরাজনৈতিক হতে হবে, যাতে সব স্তরের শিক্ষক একত্রিত হতে পারেন।
(খ) সমন্বিত নেতৃত্ব গঠন
- দক্ষ ও স্বচ্ছ নেতাদের নেতৃত্বে একটি কার্যকর আন্দোলন পরিচালনা করা প্রয়োজন।
- নেতাদের মধ্যে স্বার্থপরতা এবং ব্যক্তিগত এজেন্ডা পরিহার করতে হবে।
(গ) দাবির সংহতি তৈরি
- শিক্ষকদের বিভিন্ন স্তরের চাহিদাগুলো বিশ্লেষণ করে একটি সমন্বিত দাবিনামা প্রস্তুত করতে হবে।
- এর মাধ্যমে সবাই একত্রিত হয়ে একটি সাধারণ দাবিতে সম্মত হতে পারবেন।
(ঘ) সচেতনতা বৃদ্ধি
- শিক্ষকদের অধিকার এবং সুবিধাগুলো সম্পর্কে সচেতন করার জন্য কর্মশালা বা সভা আয়োজন করা উচিত।
(ঙ) প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার কৌশল
- সরাসরি আন্দোলনের চেয়ে আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা যেতে পারে।
- দাবি আদায়ের জন্য ধাপে ধাপে কৌশল তৈরি করা প্রয়োজন।
উপসংহার
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্যের অভাব একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা, তবে এটি সমাধানযোগ্য। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, শক্তিশালী নেতৃত্ব, এবং একটি কার্যকর ও নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম। শিক্ষকেরা যদি নিজেদের পার্থক্য ভুলে গিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করেন, তবে তারা তাদের ন্যায্য দাবিগুলো আদায় করতে সক্ষম হবেন। এটি শুধু তাদের জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও সুফল বয়ে আনবে।
Post Views: 80
Leave a Reply