বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ওঠানামা করেছে এবং মাঝে মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এই উত্তেজনার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক, সীমানা সংক্রান্ত, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। কিছু প্রধান কারণ নিচে তুলে ধরা হলো:
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল বিষয়, যা ইতিহাস, রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং মানুষের জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। সীমান্তের বিভিন্ন ইস্যু, যেমন ছিটমহল, নদী, অবৈধ অভিবাসন, এবং সীমান্তের অপরাধ প্রতিরোধের সমস্যা, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল সমস্যা ছিল একটি ঐতিহাসিক এবং জটিল সীমান্ত সমস্যা, যা ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের পর, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত নির্ধারণ হলেও কিছু ছোট ছোট এলাকা, যেখানে এক দেশ অবস্থিত ছিল কিন্তু অন্য দেশের মধ্যে ছিল, ছিটমহল (enclaves) হিসেবে পরিচিত। এই ছিটমহলগুলোর মধ্যে মানুষ এক দেশের নাগরিক হলেও অন্য দেশের অভ্যন্তরে বাস করত, যা তাদের জীবনযাত্রার জন্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।
উদাহরণস্বরূপ, ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময় ১০১টি ভারতীয় ছিটমহল এবং ৫১টি বাংলাদেশী (পূর্ব পাকিস্তান) ছিটমহল ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিল। এই ছিটমহলগুলোতে বসবাসকারী মানুষজন দুই দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বিভ্রান্ত ছিল এবং তাদের মৌলিক অধিকার (যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা, পানি, ইত্যাদি) বিপদগ্রস্ত ছিল।
২০১৫ সালে ভারত ও বাংলাদেশ এই ছিটমহল সমস্যা সমাধান করে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পন্ন করেন। চুক্তি অনুযায়ী, ১৬৪টি ছিটমহল একে অপরকে হস্তান্তরিত হয়, এবং নাগরিকদের নাগরিকত্বের বিষয়ও সমাধান করা হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে একটি বড় সমস্যা সমাধান হয়, তবে এই সমস্যা এখনও অনেক মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যা প্রায় ১৬৪০ কিলোমিটার। এই সীমান্তে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়, বিশেষত অবৈধ অভিবাসন এবং মাদক ব্যবসা।
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর উৎস ভারতের উত্তরাঞ্চলে। ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, এবং মেঘনা—এই নদীগুলোর পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়, এবং ভারতীয় প্রকল্প ও বাঁধের কারণে বাংলাদেশের পানি সরবরাহের উপর প্রভাব পড়ে। বিশেষত, গঙ্গা পানি চুক্তি (১৯৯৬) এর পরও, বাংলাদেশে পানির বণ্টন নিয়ে সমালোচনা থাকে।
নদী বণ্টন চুক্তি ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত হলেও, ফারাক্কা বাঁধ (যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজশাহী অঞ্চলের কাছে অবস্থিত) নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ এখনও রয়ে গেছে। ভারত যদি অতিরিক্ত পানি ধারণ করে, তবে বাংলাদেশে পানি সংকট তৈরি হতে পারে। এই ধরনের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা এবং সমঝোতার প্রয়োজন।
ভারত এবং বাংলাদেশের সীমান্তে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে মাঝে মাঝে সংঘর্ষ ঘটে। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (BGB) এর মধ্যে একাধিক সময় সীমান্তে সংঘর্ষ হয়েছে, যা সাধারণত সীমান্তে অপরাধীদের ধরা বা বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় ঘটে। এই সংঘর্ষগুলি মাঝে মাঝে উভয় দেশেই রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের কিছু নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে। এতে কখনো কখনো ভূমি অধিকার নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সরকার কখনো কখনো ভারতীয় নাগরিকদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে, যা দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
শীতকালে, সীমান্ত অঞ্চলে কুয়াশা এবং বন্যার কারণে সীমানা নির্ধারণে সমস্যা হতে পারে। ভারতে যদি কোনো বড় বন্যা বা কুয়াশা ঘটে, তবে সীমান্তে যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি হয় এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়, যা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা দীর্ঘকালীন এবং এটি দু’দেশের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তবে, অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে এবং দুই দেশই একে অপরকে সহযোগিতা করতে চেষ্টা করছে। সীমান্ত সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আলাপ-আলোচনা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করা সম্ভব।
কাশ্মীর ইস্যু ভারতের অন্যতম বড় এবং সংবেদনশীল সমস্যা, এবং বাংলাদেশ কখনো কখনো এই ইস্যুতে ভারতের প্রতি সমর্থন বা সমালোচনা করেছে। ভারত কাশ্মীরের আঞ্চলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে কঠোর অবস্থানে থাকলেও, বাংলাদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলো কাশ্মীরের জনগণের অধিকারের পক্ষে কথা বলে। এটি মাঝে মাঝে সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সম্পর্ক সাধারণত ভালো হলেও, সীমান্তে সংঘর্ষ, সামরিক প্রস্তুতি এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে মাঝে মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়। বিশেষত, ভারত যখন প্রতিরক্ষা খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তখন বাংলাদেশ নিজেদের প্রতিরক্ষা কৌশল এবং সামরিক সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ভারতের সাথে সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে। আওয়ামী লীগ সাধারণত ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে, তবে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল ভারতকে বেশ সমালোচনা করতে থাকে। বিশেষত, বিএনপি ভারতের প্রতি মিত্রতা কমানোর পক্ষপাতি হতে পারে, যেটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণের উপর নির্যাতন এবং বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় গ্রহণের পর, ভারত কখনো কখনো এই সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু কখনো কখনো ভারতের অভ্যন্তরীণ উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং শরণার্থী বিষয়ে উদ্বেগ থাকায় কখনো কখনো দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।
দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত যোগসূত্র থাকলেও কখনো কখনো ভারতীয় সংস্কৃতি এবং মিডিয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হতে পারে, যা সম্পর্কের উত্তেজনা বাড়ায়। এছাড়া, ভারতের কিছু সিদ্ধান্ত বা নীতির প্রভাব বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যেমন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা সম্প্রদায়িক বিষয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, শিল্প, বিনিয়োগ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হতে পারে। এই সম্পর্কটি বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নতি লাভ করেছে, যদিও কিছু সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ এখনও বিরাজমান।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই শুরু হয় এবং এটি ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করেছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য প্রধানত দুটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে:
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, ভারতের জন্য বাংলাদেশে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা করাও একটি চ্যালেঞ্জ।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে:
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে:
বাংলাদেশ এবং ভারত শক্তি খাতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করছে। ভারত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিশেষ চুক্তি করেছে, এবং বর্তমানে বাংলাদেশ বেশ কিছু রাজ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে।
ভারত বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস, শিল্প, তৈরি পোশাক, এবং ভৌগোলিক তথ্য প্রযুক্তি খাতে।
যদিও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও বিদ্যমান:
তবে, উভয় দেশই একে অপরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হতে এবং তাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্য ও সেবা প্রবাহ এবং দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সমস্যা এবং অন্যদিকে বাংলাদেশে শরণার্থীদের আগমন সম্পর্কেও উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশ যখন ভারতের বিভিন্ন সংকটের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে, তখন তা পরবর্তীতে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক মাঝে মাঝে উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে, তবে দুই দেশই তাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন সময়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। একে অপরের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা উদ্বেগের প্রতি সংবেদনশীলতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, এবং মানবিক সমস্যা এই সম্পর্কের প্রভাবিত দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে।
Leave a Reply