দেশের সবচেয়ে সম্মানিত ও দায়িত্বশীল পেশাটির নাম শিক্ষকতা আর সেই শিক্ষকতা পেশারই অপর আর একটা রূপ হলো এদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকতা পেশা। এদেশের শিক্ষার ক্ষেত্রে শতকরা ৯৮ ভাগ অবদান রাখে এই এমপিওভুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। অথচ এই পেশার বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের উপর সেই এমপিওভুক্ত শিক্ষক সমাজ এদেশে বারবার সবচেয়ে অবহেলিত, বঞ্চিত ও অপমানিত হতে হয় এই পেশার মানুষদের। উৎসবের আনন্দ যেখানে সকল নাগরিকের অধিকার, সেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা যেন সেই আনন্দ থেকে বারবার বঞ্চিত এক শ্রেণির মানুষ—যাদের দিকে তাকানোর প্রয়োজনই মনে করে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর।
সরকারি বিদ্যালয়ে নিয়োজিত শিক্ষক কর্মচারীরা যেখানে নিয়মিতভাবে ঈদ বোনাস পান, নির্ধারিত সময়েই পান এবং বেতনের শতভাগ পান। কিন্তু প্রায় চার লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীকে কেন প্রতিবার ঈদের আগে ভিক্ষারত মানুষের মতো বসে থাকতে হয়? কেন তাদের ভাতা নিয়ে চলে দফায় দফায় আদেশ-উপাদেশ, অপেক্ষা আর অনিশ্চয়তা? এই জটিলতা যে ইচ্ছাকৃত তা কিন্তু এখন এদেশের একটি ছোট শিশুকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় সেও বলবে যে হ্যাঁ এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের যে সমস্যা প্রতিমাসে বেতন প্রদানে ও উৎসবের সময় ভাতা প্রদানে তৈরি হয় তা মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছাকৃত তৈরি।
এই কি সেই দেশ যেখানে “শিক্ষকরা জাতি গঠনের কারিগর” বলে বক্তব্য দেওয়া হয়? তাহলে জাতি গঠনের কারিগরদের জন্যই কেন এমন বৈষম্য ও অবজ্ঞা? এমনিতেই একজন সরকারী ও একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে প্রদানকৃত সুযোগ সুবিধা বিস্তর ফারাক। তারপরও যদি সেই সুযোগ সুবিধা আবার সময়মতো প্রদান না করা হয় তাহলে আরও অধিক সমস্যা তৈরি করে।
ঈদ আসলেই উৎসব ভাতার প্রস্তাব যাবে, অনুমোদন পেতে সময় লাগবে, আইবাসে পাঠাতে বিলম্ব হবে—এগুলো যেন রুটিন ড্রামা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর) কি একবারও ভাবেন, এই বিলম্বের অর্থ কী? এটি একটি পরিবারে সন্তানের উৎসবের আনন্দ ম্লান করে দেয়, উৎসবের আমেজ নষ্ট করে দেয়, একজন শিক্ষকের আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। একজন শিক্ষকেরতো একটি পরিবার আছে। তারও রয়েছে বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী ও সন্তান। আছে তাদের উৎসবের চাহিদা। কিন্তু দুংখের বিষয় হলো সত্যি মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বারবার এই বিষয়ে অনুরোধ করার পরও তারা তাদের আশ্বাস বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হয়নি।
আরও লজ্জার বিষয় হলো—যেখানে শিক্ষকদের উৎসব ভাতা ২৫% থেকে ৫০% এ বাড়ানো হলো, সেখানে কর্মচারীদের জন্য কোনো বাড়তি বরাদ্দই দেওয়া হলো না। এমন বৈষম্য সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের প্রাণ, আর কর্মচারীরা সে প্রাণের চলমানতা নিশ্চিত করেন। তাদের এমন অপমান অন্যায় এবং অমানবিক।
প্রশ্ন উঠেছে—কেন প্রতিবছর এমন হয়? এর দায় কি শুধুই ফাইলপ্রক্রিয়ার ধীরগতি? নাকি এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, অনীহা ও অবজ্ঞা? যখন উৎসব ভাতা পাওয়ার কথা সংবাদ শিরোনাম হয়, তখনই বোঝা যায়—এটি কোনো নিয়মিত অধিকার নয়, বরং একটি “বিশেষ অর্জন”, যেন করুণা করে দেওয়া হয়েছে। মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণের ঔদ্ধত্যমুলক আচরণ দেখলে মনে হবে যেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের তাদের নিজস্ব তহবিলের টাকা প্রদান করছে অথবা দান করছে। অথচ এই কর্মকর্তারা নিজেদের পাওনা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিন্দু মাত্র কালক্ষেপন হয়না কখনও।
এই প্রশ্ন এখন দেশের লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মনের গভীরে জ্বলে। শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর কথা যত বলা হয়, বাস্তবে দেখা যায় শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নের চেয়ে প্রতিষ্ঠান সংস্কার বা ভৌত অবকাঠামোতেই বেশি গুরুত্ব। অথচ যিনি শিক্ষা দেন, তিনি নিজেই অর্থনৈতিক দৈন্যে থাকলে শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব? শিক্ষক যদি অদ্ধাহারে অনাহারে থাকে তাহলে উচু উচু কাঠামোতে যে শিক্ষার্থী অবস্থান করে তাদের শিক্ষা দান করবে কে?
এই অব্যবস্থার স্থায়ী সমাধানের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা জরুরি:
একটা কথা বলি মনে রাখবেন শিক্ষককে অবহেলা করা মানে এদেশের পুরো জাতিকে অবহেলা করা। এই রাষ্ট্র যদি তার শিক্ষকদের সম্মান দিতে না পারে, তাহলে উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে তা কেবল বাহ্যিক প্রদর্শনী। শিক্ষক শুধু একজন ব্যক্তি নয়, তিনি একটি জাতির চালিকাশক্তি। তাকে অবহেলা করা মানে জাতিকে পেছনে ঠেলে দেওয়া।
আজ যারা ঈদের আগেও ভাতা পাবেন কি না—সেই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন, তারাই আগামী প্রজন্মকে গড়ার চেষ্টা করছেন। সেই সত্যটা উপলব্ধি করতে হবে এখনই, নইলে আগামী দিনের ইতিহাস শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রের এই বর্বর নির্লিপ্ততার বিচার করবেই।
Leave a Reply