বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট হতে পারে এক ব্যতিক্রমী ও দিকনির্দেশনামূলক অধ্যায়। গণ-আন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার তাদের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন দেশের অর্থনীতি একাধিক জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি ৯-১০ শতাংশে স্থির থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতা এবং আমদানিনির্ভর শিল্পখাতে স্থবিরতা পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির সীমাবদ্ধতায় এলসি খোলার হার হ্রাস পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে শিল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে।
ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে, উদ্যোক্তা তৈরির হার কমে এসেছে, আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মাঝে গভীর উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে।
২০২৫ সালের বাজেট আবারও ফিরে যাচ্ছে ২০০৭-০৮ সালের সেই মুহূর্তে, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টেলিভিশনের পর্দায় বাজেট ঘোষণা হয়েছিল। এবারও এমন একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের অধীনে বাজেট উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে, যার প্রধান লক্ষ্য রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম সচল রাখা।
এ পরিস্থিতিতে, বাজেট হওয়া উচিত বাস্তবসম্মত, সংযত এবং প্রয়োগযোগ্য—যা হবে দেশের পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীলতার পথরেখা।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট করেছেন, এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তার প্রসার—এই খাতগুলোতেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
করোনা মহামারি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সম্প্রসারণ এবং বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও মাতৃত্বকালীন ভাতা বৃদ্ধি এই জনগোষ্ঠীর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হবে।
বাজেটে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে—রাস্তাঘাট, সেচব্যবস্থা ও হাট-বাজার উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতার উত্থান সম্ভব।
অন্যদিকে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—দুইটি খাতই দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যেখানে জিডিপির মাত্র ২% শিক্ষা খাতে ও ১.০৫% স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে, সেখানে প্রতিবেশী দেশগুলো অনেক বেশি ব্যয় করে। ফলে সরকারি সেবার মান নিম্নমুখী এবং জনগণ বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষার বিস্তার, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উপজেলা হাসপাতালগুলোর মানোন্নয়ন—এই খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানো হলে মানবসম্পদ উন্নয়নে তা বড় ভূমিকা রাখবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ২১ শতাংশ—যা এনবিআরের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে। করজাল সম্প্রসারণ, কর ফাঁকি রোধ, ডিজিটাল করব্যবস্থা এবং দক্ষ কর প্রশাসন গড়ে তুলতে না পারলে রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না।
তবে বাজেট ঘোষণা করাই যথেষ্ট নয়—বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি, বিলম্ব, অতিরিক্ত ব্যয় ও অনিয়ম প্রতিরোধে একটি স্বাধীন ও দক্ষ মনিটরিং সেল গঠন আবশ্যক। ভারতে ICT নির্ভর ‘রিয়েল-টাইম বাজেট ট্র্যাকিং’ ব্যবস্থা ভালো ফল দিচ্ছে—বাংলাদেশও এ পথে হাঁটতে পারে।
বাংলাদেশেরও এখন সেই মডেলের প্রয়োগ দরকার—যেখানে বাজেট কেবল কাগজে নয়, বাস্তবায়নেও দৃশ্যমান হয়।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বাংলাদেশের জন্য একটি পরীক্ষা, একটি সুযোগ—যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনআস্থা পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাসের পথরেখা তৈরি হতে পারে।
এই বাজেট যেন হয় সৎ, বাস্তবভিত্তিক, জনমুখী এবং দক্ষ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফলদায়ক—এটাই এখন দেশের সচেতন নাগরিকদের একমাত্র প্রত্যাশা।
Leave a Reply