বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত কর্মচারীরা এবার ঈদুল আযহার উৎসব ভাতা বাড়তি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। তারা আগের মতোই মূল বেতনের ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা পাবেন। এতদিন ধরে চলা আশ্বাস, প্রত্যাশা ও জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে কর্মচারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ। তাদের মতে, এটি কোনো নতুন খবর নয়, বরং দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ধারাবাহিকতা মাত্র।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রবিধি শাখার একাধিক কর্মকর্তা সোমবার (২৬ মে) জানান, কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ছে না। একই দিনে (২৬/০৫/২০২৫) এ-সংক্রান্ত সম্মতিপত্র জারি হওয়ার পর বিষয়টি চূড়ান্তভাবে স্পষ্ট হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—কীভাবে দরিদ্র কর্মচারীদের প্রহসনের মাধ্যমে ঠকানো যায়।
প্রবিধি শাখার উপসচিব মোছাম্মৎ শরিফুন্নেসা জানান, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য কর্মচারীদের ভাতা বাবদ কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এ কারণে চলতি অর্থবছরে ভাতা বৃদ্ধি করলে তা আইনি জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই উপদেষ্টা পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, “যদি এবার কর্মচারীদের বর্ধিত উৎসব ভাতা দেওয়া হলে, তবে ভবিষ্যতেও দিতে হবে। অথচ আগামী অর্থবছরে কর্মচারীদের ভাতার জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। তাই তারা আগের মতোই ৫০ শতাংশ ভাতা পাবেন। তাহলে কি আগামী বছর দিতে না হলে এবছর বাড়ানো হতো। এদেশের কোন পেশাজীবির ভাতা কি শুধু একবছরের জন্য বাড়ানো হয়।
এর আগে, গত ২১ এপ্রিল মাউশি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ঈদুল আযহা উপলক্ষে শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়াতে ২২৯ কোটি টাকার পুনঃউপযোগনের প্রস্তাব পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। ১৪ মে অর্থ মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র শিক্ষকদের ভাতা বৃদ্ধির সম্মতি দেয়, কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত না করায় নতুন করে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—যখন প্রথমে জানানো হয় যে, ভাতা বৃদ্ধি কেবল শিক্ষকদের জন্য, তখন কর্মচারীদের সংগঠন আন্দোলনে নামলে মাউশির মহাপরিচালক ও অর্থ মন্ত্রণালয় আশ্বস্ত করেন, এটি কেবল একটি বোঝাপড়ার ভুল। তখন কোথাও আইনি জটিলতার কথা বলা হয়নি। এখন হঠাৎ করেই সেই ‘আইনি জটিলতা’ কোথা থেকে এলো? যদি সত্যিই কোনো আইনি জটিলতা থাকত, তাহলে শুরুতেই তা স্পষ্ট করা যেত। কেন বারবার আশ্বাস দিয়ে কর্মচারীদের বিভ্রান্ত করা হলো?
এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে—এমপিওভুক্ত কর্মচারীরা কি শুধুই “কর্মচারী” বলে তাদের প্রতি এমন অবজ্ঞা-উপেক্ষা মানায়? শিক্ষকদের উৎসব ভাতা ২৫% বাড়ানো হলে তা আইনসম্মত, কিন্তু কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সেটা ‘জটিলতা’? শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যখন বছরে ১২টি উৎসব ভাতা গ্রহণ করেন, তখন কোনো আইনগত বাধা থাকে না। অথচ একজন পিয়ন, অফিস সহকারী বা হিসাব সহকারীর ভাতা বাড়াতে গিয়ে আইন কাঠগড়ায় চলে আসে?
প্রথমে বলা হলো বাজেট ঘাটতির কারণে ভাতা বাড়ানো সম্ভব নয়, পরে বলা হলো বোঝার ভুল, এরপর আবার আশ্বাস দিয়ে জানানো হলো সমস্যা সমাধান হচ্ছে, এবং সর্বশেষ জানানো হলো আইনি জটিলতা রয়েছে। এই ধরনের প্রহসনমূলক আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও মাউশির দুর্বলতা ও অদক্ষতার কারণে বারবার কর্মচারীরা প্রতারিত হচ্ছেন। তারা কত শতাংশ ভাতা পান—তা যেন কেউ জানেই না! প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও অর্থ মন্ত্রণালয় বোঝেনি যে, কাদের ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
মাননীয় মহাপরিচালক মহোদয়, আমরা মনে করি—একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। আপনি কিংবা আমি যে কাজগুলো করি না, সেই সব কাজই তারা নীরবে করে যান। সেই কাজগুলো তাদের আত্মমর্যাদার সাথেই জড়িত। তাদের এভাবে বারবার অপমানিত করা কখনোই ন্যায়সঙ্গত নয়।
উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলা হলেও প্রশ্ন থেকেই যায়—অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই তো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন আইন কোথায় থাকে? তাহলে এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের বেলায় কেন আইনশাসনের এত কঠোর প্রয়োগ? এ যেন একপাক্ষিক বিচারপ্রক্রিয়া।
এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্তটি কেবল একটি আর্থিক বিষয় নয়—এটি একটি ন্যায়ের প্রশ্ন, মর্যাদার প্রশ্ন। এ সিদ্ধান্ত যে কেবল অন্যায় তা নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত অবিচার। আর অবিচারকে যদি আইন ও প্রক্রিয়ার মোড়কে উপস্থাপন করা হয়, তবে তা প্রতারণারই নামান্তর। আগামীতেও তাদের ভাতা না বাড়ানোর ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও হতাশাজনক করে তুলেছে। আমরা আশা করি, এই অবিচারের দ্রুত সংশোধন হবে, এবং নীতিনির্ধারকরা কর্মচারীদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেবেন।
Leave a Reply