উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, রাজশাহী অঞ্চল, রাজশাহী’র আওতাধীন এমপিওভূক্ত সকল বেসরকারি কলেজ, স্কুল এন্ড কলেজ এবং স্কুল-এ কর্মরত যেসকল শিক্ষক-কর্মচারী বিধি বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত বেতন, বকেয়া, ইনক্রিমেন্ট এবং ইনক্রিমেন্টের বকেয়া গ্রহণ করেছেন সেসকল শিক্ষক-কর্মচারীগণ আগামী ০৫ (পাঁচ) কর্মদিবসের মধ্যে যথাযথ হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে নিম্নে উল্লিখিত কোডে অতিরিক্ত উত্তোলিত অর্থ ফেরত প্রদান করে নিম্নস্বাক্ষরকারীর দপ্তরে প্রমাণকের কপি জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় আপনার/আপনাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আমরা যারা এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারী, অনেকেই হয়ত সাম্প্রতিক সময়ের একটি আলোচিত বিষয় সম্পর্কে কমবেশি শুনেছি—বেতন স্কেল পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের দায় এবং তা ফেরতের নির্দেশ। এই জটিলতার মধ্যে কে কে পড়েছেন, আর কারা পড়েননি—এটি বোঝার চেষ্টা করা এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
প্রথমেই আসি, ইনক্রিমেন্ট (বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি) প্রাপ্তি প্রসঙ্গে।
২০১৮ সাল থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট পেতে শুরু করেন। বর্তমানে (২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে) কেউ কেউ সর্বোচ্চ ৭টি ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো—এই ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের সম্পর্ক কোথায়?
ইনক্রিমেন্ট নিজে কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু যখন শিক্ষক/কর্মচারীর বেতন স্কেল (কোড) পরিবর্তন হয়, তখন পূর্বের ইনক্রিমেন্ট বাতিল হয়ে নতুন স্কেল অনুযায়ী বেতন নির্ধারিত হয়, যাকে বলা হয় বেতন ফিক্সেশন। এখানেই ভুল হলে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
বাৎসরিক বৃদ্ধির সাথে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের বিষয়টি কিভাবে জড়িত সেটাই আমরা একটু দেখার চেষ্টা করি। তার আগে আর একটা বিষয় পরিস্কার করি তা হলো একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যে বেতন স্কেলগুলোতে পর্যায়ক্রমে অন্তর্ভুক্ত হন সেগুলো হলো, ১১,১০,৯,৮,৭। এর মধ্যে ৮ ও ৭ নং কোডের বেতন স্কেল প্রাপ্তদের সমস্যা হবে না। সমস্যা হবে বেতন কোড ১১ থেকে যখন বেতন কোড ১০ প্রাপ্ত হবেন শিক্ষকগণ ও বেতন কোড ১০ থেকে যখন বেতন কোড ৯ প্রাপ্ত হবেন যখন শিক্ষকগণ। বাৎসরিক বৃদ্ধির মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের বিষয়ের সাথে যে বেতন কোড গুলো সাংঘর্ষিক সেগুলো হলো বেতন কোড-১১ ও বেতন কোড-১০, বেতন কোড-৯।
ধরুন, একজন শিক্ষক বেতন কোড-১১ এর আওতায় চাকরি শুরু করেন। এই কোড অনুযায়ী তার মূল বেতন নির্ধারিত হয় ১২,৫০০ টাকা। তিনি দুই বছর কর্মরত থাকায়, নিয়ম অনুযায়ী দুইটি বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট লাভ করেন, যার ফলে তার মূল বেতন দাঁড়ায় ১৩,৭৯০ টাকা।
এখন, ধরুন এই শিক্ষক বি.এড (B.Ed) ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। সরকারী বিধি অনুযায়ী, বি.এড ডিগ্রির ভিত্তিতে তিনি পরবর্তী বেতন স্কেল (বেতন কোড-১০) এ উন্নীত হন, যার প্রারম্ভিক মূল বেতন ১৬,০০০ টাকা।
এখানেই একটি সাধারণ ভুল অনেকেই করে থাকেন।
তারা মনে করেন, যেহেতু শিক্ষক পূর্বের কোডে (১১) দুইটি ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন, সেহেতু কোড পরিবর্তনের পরও এই ইনক্রিমেন্ট বজায় থাকবে, এবং সেই হিসেবে তার মূল বেতন হবে:
১৬,০০০ + ২টি ইনক্রিমেন্ট = ১৭,৬৪০ টাকা।
কারণ হলো, যখনই একজন কর্মচারীর বেতন কোড পরিবর্তন হয়, তখন পূর্ববর্তী স্কেলের সমস্ত ইনক্রিমেন্ট বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ, নতুন স্কেলে প্রবেশ করার সময় বেতন নতুন স্কেলের প্রারম্ভিক ধাপ থেকেই শুরু হয়, পুরাতন ইনক্রিমেন্টগুলো আর কার্যকর থাকে না।
তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম রয়েছে, যেটি হচ্ছে ফিক্সেশন (Fixation)। এই নিয়ম অনুযায়ী:
এই উদাহরণে, শিক্ষক যেহেতু কোড-১১ তে ১৩,৭৯০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছেন এবং কোড-১০ এর প্রারম্ভিক বেতন ১৬,০০০ টাকা, যা আগের চেয়ে বেশি, তাই কোনো ধাপ যুক্ত না করেই ১৬,০০০ টাকা থেকেই তার নতুন বেতন শুরু হবে।
এই পরিস্থিতিতে বিষয়টি হবে বৈধতা বহির্ভূত অর্থ উত্তোলন। যেহেতু পূর্বের ইনক্রিমেন্ট বাতিল হয়ে গিয়েছে, তাই ১৭,৬৪০ টাকা ধরে নেওয়া নিয়মবহির্ভূত। পরবর্তীতে নিরীক্ষা বা ট্রেজারি যাচাইয়ে বিষয়টি ধরা পড়লে তাকে সেই অতিরিক্ত গ্রহণকৃত অর্থ ফেরত দিতে হবে।
ধরুন, একজন শিক্ষক দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বেতন কোড-১০ অনুযায়ী চাকরি করে আসছেন। কোড-১০ এর আওতায় মূল বেতন শুরু হয় ১৬,০০০ টাকা থেকে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর একটি করে ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হয়, এবং এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ সর্বোচ্চ ৭টি ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন।
সুতরাং, এই শিক্ষক বর্তমানে পেয়েছেন:
১৬,০০০ টাকা + ৭টি ইনক্রিমেন্ট = ২২,৫৫০ টাকা মূল বেতন।
এখন, কোনো কারণে (যেমন: উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন বা পদোন্নতি) যদি তার বেতন স্কেল উন্নীত হয়ে বেতন কোড-৯ তে উন্নীত হয়, তবে তাকে একটি নতুন স্কেলে স্থানান্তর করা হবে।
বেতন কোড-৯ অনুযায়ী প্রারম্ভিক মূল বেতন ২২,০০০ টাকা। অনেক সময় ভুলভাবে ধারণা করা হয় যে, এই নতুন স্কেলে যাওয়ার পর শিক্ষক তার পূর্বের ৭টি ইনক্রিমেন্ট বহাল রাখবেন এবং সেই হিসেবে তার নতুন বেতন দাঁড়াবে:
২২,০০০ টাকা + ৭টি ইনক্রিমেন্ট = ৩০,৯৯০ টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, যখন বেতন কোড পরিবর্তন হয়, তখন পূর্ববর্তী স্কেলের সমস্ত ইনক্রিমেন্ট বাতিল হয়ে যায়। নতুন স্কেলে ফিক্সেশন (Fixation) পদ্ধতিতে বেতন নির্ধারণ করা হয়।
বেতন কোড-১০ এ শিক্ষক যেহেতু ২২,৫৫০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছেন এবং কোড-৯ এর শুরু হচ্ছে ২২,০০০ টাকা থেকে — তাহলে প্রথম নজরে মনে হতে পারে, নতুন স্কেলের বেতন আগের চেয়ে কম, যা নিয়মবিরুদ্ধ।
কিন্তু এই অবস্থায়, ফিক্সেশন নিয়ম অনুসারে, শিক্ষকের নতুন স্কেল (বেতন কোড-৯) এর মধ্যে এমন একটি ধাপ (ইনক্রিমেন্ট ধাপ) নির্ধারণ করা হবে যা তার আগের বেতনের সমান বা তার চেয়ে একটু বেশি হয়।
এই ক্ষেত্রে, বেতন কোড-৯ এর পরবর্তী ধাপ হলো ২৩,১০০ টাকা। যেহেতু এটি পূর্বের ২২,৫৫০ টাকার চেয়ে বেশি, তাই এই ধাপ থেকেই তার নতুন বেতন নির্ধারণ করা হবে।
অর্থাৎ, শিক্ষকের নতুন ফিক্সড বেতন হবে ২৩,১০০ টাকা, এবং এই বেতন থেকেই তার পরবর্তী ইনক্রিমেন্ট, গ্র্যাচুইটি, পেনশনসহ সকল সুবিধার হিসাব শুরু হবে।
এই ক্ষেত্রে এটি হবে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ, যা শিক্ষক ভুলবশত উত্তোলন করে থাকলে পরবর্তীতে তাকে সরকারি ট্রেজারিতে ফেরত দিতে হবে। কারণ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বেতন কখনও পূর্বের চেয়ে কম হয় না, তবে বেশি হলে তা অবশ্যই সঠিক প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত হতে হবে।
অনেকেই জানতে চান—বেতন কোড-৯ থেকে বেতন কোড-৮ এ উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষকরা কেন অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের সমস্যায় পড়েন না, বা কেন তাদের কোনো টাকা ফেরত দিতে হয় না। বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে সংশ্লিষ্ট স্কেলগুলোর কাঠামো বিশ্লেষণ করতে হবে।
ধরুন, একজন শিক্ষক বিগত ৫ বছর ধরে বেতন কোড-৯ অনুযায়ী চাকরি করে আসছেন। প্রতি বছর একটি করে ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী তার বর্তমান মূল বেতন দাঁড়িয়েছে:
২২,০০০ + ৫টি ইনক্রিমেন্ট = ২৮,১০০ টাকা
এখন তিনি কোন যোগ্যতা অর্জন বা নিয়ম অনুযায়ী বেতন কোড-৮ এ উন্নীত হলেন, যার প্রারম্ভিক স্কেল শুরু হয় ২৩,০০০ টাকা থেকে। এই পর্যায়ে দেখা গেল, নতুন স্কেলের শুরুটা পুরাতন বেতনের তুলনায় কম (২৩,০০০ < ২৮,১০০)। কিন্তু সরকার নির্ধারিত ফিক্সেশন বিধি অনুযায়ী কোনো অবস্থাতেই বেতন কমে যেতে পারে না।
ফিক্সেশন নিয়ম অনুযায়ী, নতুন স্কেলের মধ্যে এমন একটি ধাপ খুঁজে বের করা হবে যার মাধ্যমে শিক্ষকের নতুন বেতন পুর্বের বেতনের সমান বা তার চেয়ে সামান্য বেশি হয়। অর্থাৎ, এই শিক্ষকের বেতন নতুন কোডে ফিক্সেশন করতে হবে এমনভাবে, যাতে তার বেতন হয় কমপক্ষে ২৮,১০০ টাকা বা তার বেশি।
যদি তাকে ৪টি ইনক্রিমেন্ট দিয়ে ২৩,৯৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়, তাহলেও তা পুর্বের চেয়ে কম হয়:
২৩,০০০ + ৪ ইনক্রিমেন্ট = ২৭,৯৭০ টাকা
যা ২৮,১০০ টাকার চেয়ে কম।
❌ এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
✅ পরবর্তীতে, যখন ৫টি ইনক্রিমেন্ট যুক্ত করা হয়, তখন নতুন বেতন দাঁড়ায়:
২৩,০০০ + ৫ ইনক্রিমেন্ট = ২৯,৩৭০ টাকা
এবার এটি পূর্বের বেতনের (২৮,১০০ টাকা) চেয়ে বেশি হওয়ায় এই স্কেলেই তার বেতন ফিক্সড হবে।
বেতন কোড-৯ থেকে কোড-৮ এ যাওয়া শিক্ষকরা যে সমস্যায় পড়েন না, তার মূল কারণ হলো—নতুন স্কেল পুরাতনের তুলনায় উচ্চতর হওয়ায় ফিক্সেশনের মাধ্যমে তাদের পূর্বের ইনক্রিমেন্ট বজায় থাকে এবং কোনো অতিরিক্ত অর্থের ইস্যু তৈরি হয় না। সুতরাং, এদের বেলায় অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের প্রশ্নই আসে না, এবং টাকা ফেরতের ঝামেলাও থাকে না।
এখন আর একটা বিষয় সামনে অনেকে আনতে পারেন প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল তো ২৯০০০টাকা তাদের কি এই ঝামেলায় পড়তে হবে কি না। উত্তর হল না কারণ তাদের কোন বেতন স্কেলের পরিবর্তন হয় না বিধায় তাদের এই ঝামেলা পড়তে হবে না। তারা একটি স্কেলই প্রাপ্ত হন সেটা হল বেতন কোড-৭।
পরিশেষে যে কথা বলতে চাই তা হলো আমি চেষ্টা করেছি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বিষয়গুলো সহজ ভাবে বোঝানোর যদি কারও নিকট বিষয়টি বুঝতে এখনও কোন সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে আমার সাথে ব্যাক্তিগতভাবে যোগাযোগ করতে পারেন বা কমেন্টবক্সে কমেন্ট করবেন আমি সমাধান করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
আর সর্বশেষ যে উপদেশ মুলক কথা বলব তা হল এই যে, যারা এধরনের অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের ঝামেলায় পড়েছেন তাহারা দয়া করে অতিরিক্ত উত্তোলিত অর্থ হিসাব করে যত দ্রুত সম্ভব সরকারী ট্রেজারিতে চালানের মাধ্যমে ফেরত দিয়ে দিবেন তা না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হতে পারে যে কোন সময়। এখন না হলেও চাকুরী শেষে অবশম্ভাবী ভাবে এই ঝামেলার মুখোমুখি হবেন।
Leave a Reply