বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীর আয়ের পথ অত্যন্ত সীমিত এবং নগন্য। তারপর আবার সেই আয় যদি মাসের শেষে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পাওয়া না যায় তাহলে তা আরও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। কোন ১০ তারিখে পাওয়া গেলে কোন মাসের ২০ তারিখ কোন মাসের বেতন পেতে পেতে আবার মাস শেষ হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত এধরনের অনিয়ম যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের বেলায়। এব্যাপারে মাউশির দায়িত্ব প্রাপ্তদের সাথে বিভিন্ন সময় আলাপ আলোচনা ও মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে যে অনিয়ম গুলোর বিষয়ে জানা যায় তা নিচে তুলে ধরা হলো।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কর্তৃক এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন প্রদানে বিলম্ব ও তার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ তুলে ধরে:
একজন শিক্ষক—যিনি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে প্রতিদিন ব্যস্ত—প্রতি মাসে যখন নিজের প্রাপ্য বেতনের জন্য দুশ্চিন্তায় থাকেন, তখন সেটা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এক ধরনের সামাজিক অসম্মানও। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা আজ সেই অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিমাসে বেতন পেতে তাদের যে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়, তার মূল কারণ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এর ভেতরের অনিয়ম, অবহেলা ও অপেশাদারিত্ব।
মাউশির নীতিনির্ধারক ও ব্যবস্থাপনাকারীদের দৃষ্টিরতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনপ্রদান যেন সবসময়ই ‘কম গুরুত্বের’ তালিকায় পড়ে। তারা যেন মনেই করে না যে, এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের নির্দিষ্ট সময় বেতন প্রদান করা উচিত। তাদের মধ্যে এই ধারাণা বদ্ধমুল যে, তাদেরকে আমাদের যখন খুশি হবে তখন বেতন প্রদান করব এটা আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর। ফলাফল—প্রক্রিয়া চলে ধীরগতিতে, উৎসাহ ছাড়াই।
অনেক সময় মাউশির কিছু কর্মকর্তা সচেতনভাবেই ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ফাইল আটকে রাখেন। তাঁরা মনে করেন, “আমার অনুমোদন ছাড়া কিছুই হবে না।” এটি শুধু অমানবিকই নয়, প্রশাসনিক দায়িত্ববোধের ঘোরতর লঙ্ঘন। এভাবে দিনের পর দিন যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকে একসময় চরম বিশৃংখলা দেখা দিবে যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অনেক সময় অজুহাত তৈরি করে ফাইলপত্র আটকে রাখেন—ছুটিতে আছেন, বৈঠকে আছেন, কিংবা সিস্টেমে সমস্যা আছে, কাজ রেখে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ তাদের কারণে একটি পেশাজীবি সমাজ দিনের পর সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। যা কিনা চরম থেকে চরমতর অন্যায়। তার যতই নিজেদের অতি চালাক মনে করুক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে, এ বিলম্ব ইচ্ছাকৃত তা প্রায়ই সবাই জানে।
সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা, কাজের বোঝা ভাগ না করে কেন্দ্রীয়করণই ধরে রাখা এবং আধুনিক সফটওয়্যার ও প্রযুক্তির প্রতি অনীহার কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। তারা ইচ্ছা করলেই কাজ গুলো বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে উপজেলা ও জেলা পর্যায় থেকে কাজ গুলো ভাগ করে দিয়ে সঠিক সময়ে কাজগুলো সম্পুর্ণ করতে পারে। যেমন করে প্রাইমারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইএফটি নিয়ন্ত্রিত হয়।
৫. অপর্যাপ্ত লোকবল
মাউশি সকল সময় যে দায় দেখায় তা হলো অপর্যাপ্তত লোকবল। তারা যে কথা বলার চেষ্টা করে যে, তাদের লোকবল অত্যান্ত সীমিত যেমন ইএমআইসেলের লোকবল সংখ্যা মাত্র ১৪ জন। এটা ঠিক এই সংখ্যক লোকবল দিয়ে সমগ্র দেশের শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করা অত্যন্ত দূরহ। তাহলে এ বিষয়ে সরকারের নিকট প্রয়োজনীয় লোকবলের জন্য চাহিদা দেওয়া উচিত। সরকার যদি প্রয়োজনীয় লোকবল সরবরাহ না করে তাহলে কাজ বিকেন্দ্রীকরণে মাধ্যমে করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। তাই বলে তো আপনি লোকবলের অভাবের দোহাই দিয়ে প্রতিমাসে প্রতিক্ষণে শিক্ষক কর্মচারীদের বিভিন্ন বিষয়ে হয়রানি করবেন এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। সঠিক সংখ্যক দক্ষ কর্মী না থাকায় ফাইল একেক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে গিয়ে পড়ে থাকবে দিনের পর দিন এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি অনেক সময় নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে ভুল-ত্রুটি ও দেরি আরও বেড়ে যায়।
ইএফটি (EFT) পদ্ধতি চালু হলেও,র তা শুধু কাগজে কলমে। বাস্তবে তার সুফল পাচ্ছে না শিক্ষকরা। মাউশির অনেক কর্মকর্তাই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অদক্ষ বা অনিচ্ছুক। মাউশির অনেক কর্মকর্তারাই মনে প্রাণে চায় না যে, এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ইএফটির মাধ্যমে প্রেরণ করা হোক। তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ভোগান্তি তৈরি করছে যাতে পূর্বের নিয়মে ফিরে যাওয়া যায়।
প্রতিবারই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনপ্রদানে দেরি হলে দায় চাপানো হয় শিক্ষকদের উপর—“তথ্য সঠিক দেননি”, “প্রোফাইল ভুল”, “ডেটা আপডেট হয়নি” ইত্যাদি। অথচ শিক্ষকরা প্রতিবছরই EMIS-এ তথ্য হালনাগাদ করে থাকেন। সেখানে সকল শিক্ষক কর্মচারীর সঠিক তথ্য খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে। এটি একটি হাস্যকর অভিযোগ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, মাউশির ভেতরে এমন কিছু কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ইএফটি পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন চান না। কারণ?
👉 স্বচ্ছ ও ডিজিটাল ব্যবস্থায় দুর্নীতির সুযোগ কমে যাবে,
👉 “ফাইল চালিয়ে সুবিধা নেওয়ার” পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
তাই তারা নানা অজুহাতে সমস্যা সৃষ্টি করেন, বিলম্ব ঘটান এবং পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো দেখুন, একটি জাতিকে গড়ার প্রধান হাতিয়ার—শিক্ষক। আর সেই শিক্ষক যদি নিজেই হয় অবহেলার শিকার, তাহলে কীভাবে আমরা আশা করব, তারা নিঃস্বার্থভাবে জাতিকে গড়বেন? এদেশের প্রায় ৯৭%-৯৮% শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে শিক্ষিত করার গুরু দায়িত্ব কিন্তু এই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উপর।
মাউশি কর্তৃপক্ষের উচিত এখনই আত্মসমালোচনার পথে হেঁটে এই অনিয়ম বন্ধ করা এবং ইএফটি পদ্ধতিকে সত্যিকার অর্থেই স্বয়ংক্রিয় ও মানবিক করে তোলা। নইলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ শিক্ষকরা কেবলই ‘ফাইলের বন্দী’ হয়ে থাকবেন। নামেই আমরা আধুনিক হব, আক্ষরিক অর্থে পড়ে থাকব অন্ধকারের অতল গহ্বরে।
Leave a Reply