সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশদ আলোচনা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি (Creative Question Method) ২০১০ সালে চালু করা হয়। এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা, এবং বাস্তবজীবনের সমস্যার সমাধান করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। যদিও এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, এর বাস্তবায়নে নানামুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে। এখানে সৃজনশীল পদ্ধতির বিভিন্ন দিক বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:
সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
মূল লক্ষ্য:
- চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণী দক্ষতা বৃদ্ধি: শিক্ষার্থীদের ধারণা ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা।
- মুখস্থ নির্ভরতা হ্রাস: শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার প্রবণতা থেকে বের করে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে জ্ঞানকে সংযুক্ত করা।
- গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত: সৃজনশীলতার মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নত করা।
- জীবনমুখী শিক্ষণ: শিক্ষার্থীদের বাস্তব সমস্যার সমাধানে সক্ষম করে তোলা।
সৃজনশীল পদ্ধতির ইতিবাচক দিক
১. শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বৃদ্ধি
- শিক্ষার্থীরা যখন বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার জন্য নিজস্ব চিন্তাভাবনা প্রয়োগ করে, তখন তাদের সৃজনশীলতা বিকশিত হয়।
- একাধিক সমাধান উদ্ভাবনের সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীরা উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে চিন্তা করতে শেখে।
২. মুখস্থবিদ্যা থেকে মুক্তি
- প্রচলিত প্রশ্নব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের কেবল মুখস্থের দিকে ধাবিত করত। কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতি তাদের অনুধাবন ক্ষমতা ও বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা বাড়ায়।
৩. বাস্তবমুখী শিক্ষা
- সৃজনশীল প্রশ্ন বাস্তব জীবনের উদাহরণের সাথে জড়িত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের জীবনের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।
৪. মানসম্মত শিক্ষা
- এটি শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়ক, কারণ শিক্ষার্থীদের উপর চাপ না দিয়ে, তাদের প্রকৃত জ্ঞান এবং দক্ষতা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়।
সৃজনশীল পদ্ধতির চ্যালেঞ্জসমূহ
সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ভালো হলেও বাংলাদেশে এর কার্যকর বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য সমস্যা রয়েছে।
১. শিক্ষকদের অপ্রস্তুতি
- অনেক শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতির ধারণা সম্পর্কে ভালোভাবে প্রশিক্ষিত নন।
- সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি এবং সঠিক মূল্যায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব রয়েছে।
২. প্রশ্নপত্রের জটিলতা
- সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক শিক্ষক এমন প্রশ্ন তৈরি করেন, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক বা অত্যন্ত জটিল হয়ে যায়।
- অনেক সময় প্রশ্নপত্র সৃজনশীলতার পরিবর্তে বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়ে।
৩. গাইড বইয়ের উপর নির্ভরতা
- শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল চিন্তাভাবনার চর্চা করার পরিবর্তে গাইড বইয়ের প্রস্তুতকৃত উত্তর মুখস্থ করে।
- এটি সৃজনশীল পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।
৪. মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার সমস্যা
- উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় অনেক পরীক্ষক সৃজনশীল উত্তরের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেন না।
- সঠিক মূল্যায়নের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরীক্ষকের অভাব রয়েছে।
৫. অতিরিক্ত চাপ
- অনেক শিক্ষার্থী সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মানসিক চাপ অনুভব করে।
- সঠিক দিকনির্দেশনা এবং শিক্ষকদের সহায়তার অভাবে শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে।
৬. প্রযুক্তি ও অবকাঠামোর অভাব
- গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির অভাব সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
- মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম বা ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীরা আধুনিক পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে না।
৭. ক্লাসরুমের ভিড় ও শিক্ষকের অভাব
- অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ভারসাম্যপূর্ণ নয়।
- একজন শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পর্যাপ্ত সময় পান না।
সৃজনশীল পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য সুপারিশ
সৃজনশীল পদ্ধতির সফল বাস্তবায়নের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১. শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ
- শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি ও মূল্যায়নের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- ডিজিটাল প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পদ্ধতি শেখানো যেতে পারে।
২. প্রশ্নের গুণগত মান নিশ্চিত করা
- সৃজনশীল প্রশ্ন বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ও শিক্ষার্থীর মানসিক দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
- জটিল ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এড়িয়ে সঠিক কাঠামোতে প্রশ্ন তৈরি করতে হবে।
৩. গাইড বই নির্ভরতায় রোধ
- শিক্ষার্থীদের গাইড বইয়ের মুখস্থ নির্ভরতায় নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং তাদের পাঠ্যবইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হবে।
- ক্লাসে পাঠ্যবইয়ের পাঠ্যাংশ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত।
৪. প্রযুক্তির ব্যবহার
- বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ইন্টারনেট সুবিধা এবং ডিজিটাল সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে।
- অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সৃজনশীল প্রশ্ন চর্চার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
৫. শিক্ষার্থীদের চাপ কমানো
- শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করার জন্য সৃজনশীল পদ্ধতিকে আরও মজার এবং সহজ করে উপস্থাপন করতে হবে।
- সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কৌশল শেখানোর জন্য নিয়মিত ওয়ার্কশপ বা ক্লাস নেওয়া যেতে পারে।
৬. পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ
- শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ভারসাম্যপূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।
- শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা তাদের উৎসাহিত করবে।
৭. গ্রামীণ এলাকায় বিশেষ মনোযোগ
- গ্রামীণ এলাকায় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রসারে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ জরুরি।
- এই এলাকাগুলোতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার
সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি একটি যুগোপযোগী শিক্ষণ কৌশল, যা শিক্ষার্থীদের মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে সৃজনশীল ও বিশ্লেষণী দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। তবে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি পুরোপুরি কার্যকর করতে গেলে প্রশিক্ষিত শিক্ষক, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং শিক্ষার্থীদের জন্য চাপমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে শিক্ষার মানোন্নয়নে এটিকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।
Post Views: 80
Leave a Reply