মানসম্মত বেতন ও মানসম্মত শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা: বিশদ আলোচনা
শিক্ষা একটি জাতির উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। আর শিক্ষকদের মান ও পেশাগত দক্ষতা শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে অপরিহার্য। কিন্তু যদি শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন ও সুযোগ-সুবিধা না দেওয়া হয়, তাহলে মানসম্মত শিক্ষকের চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
নিচে এই বিষয়টি বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:
১. শিক্ষকের ভূমিকা এবং বর্তমান চিত্র
- একজন শিক্ষক শুধু জ্ঞান বিতরণ করেন না, তিনি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাতা। তার নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের চিন্তাধারা, মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ গঠনে সহায়ক হয়।
- বাংলাদেশে, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন কাঠামো অনেকটাই অপ্রতুল। এমপিওভুক্ত শিক্ষক চাকুরীর শুরুতে বেতন পান মোটের উপর 12000 টাকা।
- একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের গড় বেতন প্রায় ১২,০০০ থেকে ১৮,০০০ টাকার মধ্যে। এটি বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একজন শিক্ষকের জন্য যথেষ্ট নয়।
২. বেতন-সুবিধা এবং মানসম্মত শিক্ষকের অভাবের কারণ
(ক) অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ:
- কম বেতনের কারণে উচ্চশিক্ষিত, দক্ষ এবং প্রতিশ্রুতিশীল ব্যক্তিরা শিক্ষকতার পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
- অনেক শিক্ষক টিউশন বা অন্য পেশার মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা করেন, যা শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেয়।
- অর্থনৈতিক টানাপোড়েন শিক্ষকদের কর্মস্পৃহা কমিয়ে দেয়।
(খ) সামাজিক মর্যাদা হ্রাস:
- বেতন কম থাকায় শিক্ষকতার পেশার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এটি সমাজে পেশাটির মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে। ফলে অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য তালিকা থেকে শিক্ষকতার পেশা বাদ পড়ছে।
- অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে সামাজিক ভাবে তারা হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।
(গ) অভিজ্ঞতার অভাব:
- কম বেতনে পেশাদার শিক্ষকরা দীর্ঘ সময় ধরে একটি প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান না। তারা ভালো সুযোগ পেলে দ্রুত পেশা পরিবর্তন করেন, যা শিক্ষার ধারাবাহিকতায় প্রভাব ফেলে।
৩. মানসম্মত বেতন শিক্ষার মান উন্নত করে কীভাবে
(ক) যোগ্য প্রার্থীর আকর্ষণ:
- ন্যায্য বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিশ্রুতিশীল ব্যক্তিরা শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট হবেন।
- এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করবে।
(খ) শিক্ষকের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি:
- পর্যাপ্ত বেতন একজন শিক্ষককে পেশার প্রতি উৎসাহী করে তোলে। এটি তাদের সৃজনশীলতা, পেশাদারিত্ব এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সময় দেওয়ার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়।
(গ) শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি:
- একটি ভালো বেতন কাঠামো শিক্ষকদের মানসিক চাপ কমায় এবং তাদের শিক্ষাদানে মনোযোগী করে তোলে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের ফলাফল উন্নত হয় এবং জাতি উপকৃত হয়।
৪. আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
বিভিন্ন দেশের উদাহরণ থেকে দেখা যায়, যেখানে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো উন্নত, সেখানে শিক্ষার মানও উচ্চ।
উদাহরণ:
- ফিনল্যান্ড:
- ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের বেতন অনেক বেশি এবং তারা শিক্ষার মানের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
- ফিনিশ সরকার শিক্ষক উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করে, যা শিক্ষার মান বৃদ্ধি করে।
- জাপান:
- জাপানে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি এবং বেতনও প্রতিযোগিতামূলক। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও মানোন্নয়নের মনোভাব সৃষ্টি হয়।
- দক্ষিণ কোরিয়া:
- উচ্চ বেতন শিক্ষকদের পেশার প্রতি উৎসাহিত করেছে এবং দেশটি শিক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্যের নজির স্থাপন করেছে।
৫. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করণীয়
(ক) বেতন কাঠামোর সংস্কার:
- শিক্ষকদের জন্য একটি জাতীয় ন্যূনতম বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা উচিত। এটি শিক্ষকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং কাজের ধরন অনুযায়ী নির্ধারণ করা যেতে পারে।
- মানসম্মত বেতনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামোর ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হবে।
- সরকারী শিক্ষকের সাথে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের বেতন ব্যবধান দুর করতে হবে।
(খ) ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা:
- বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, এবং উৎসব ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
- বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় কর্মরত শিক্ষকদের জন্য অতিরিক্ত ভাতা প্রবর্তন করা যেতে পারে।
- ইনসেনটিভ বোনাস এর ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হবে।
- ছুটি কম কাটানোকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
(গ) প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন:
- বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করা উচিত। এটি তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াবে।
(ঘ) এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মান যাচাই:
- এমপিও সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এটি শিক্ষার মান বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
- তাদের সমস্যাগুলো কোথায় তার খোঁজ খবর রাখতে হবে।
(ঙ) সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা:
- সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে হবে।
- দেশের বিত্তবানদের সেবার মানসিকতা নিয়ে শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে।
উপসংহার
“শিক্ষকের মানই শিক্ষার মান নির্ধারণ করে।” শিক্ষকরা যদি আর্থিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন, তবে তারা শিক্ষার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন না। তাই মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হলে ন্যায্য বেতন ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি শিক্ষার মানোন্নয়নে সবচেয়ে কার্যকর বিনিয়োগ হিসেবে প্রমাণিত হবে।
Post Views: 80
Leave a Reply