এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জিম্মি হওয়ার অনুভূতি বাস্তবিক এবং এটি মূলত কিছু কাঠামোগত এবং প্রশাসনিক সমস্যার ফলে ঘটে। শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও তারা প্রায়শই অবমূল্যায়িত এবং তাদের ন্যায্য চাহিদাগুলো উপেক্ষিত হয়। এই পরিস্থিতির কারণ ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. সমস্যাগুলোর মূল কারণ
ক. সীমিত আর্থিক সুবিধা ও অধিকার
- এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো সুবিধা পান না। বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা অনেক সময় প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত হয় না।
- তাদের অধিকাংশই চাকরিতে স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পান না।
খ. নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় উপেক্ষা
- জাতীয় শিক্ষানীতিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বিষয়টি প্রাধান্য পায় না।
- তাদের সাথে সুনির্দিষ্ট আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না, যা তাদের নীতিমালার বাইরে রাখতে পারে।
গ. জাতীয়করণের অভাব
- এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দীর্ঘদিন ধরে জাতীয়করণের দাবি উপেক্ষিত রয়েছে।
- জাতীয়করণের মাধ্যমে তারা সরকারি শিক্ষকদের মতো সুবিধা পেতেন, যা তাদের কাজের পরিবেশ এবং মান উন্নত করত।
ঘ. প্রশাসনিক জটিলতা
- প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হয় না।
- অনেক সময় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়, যা শিক্ষকদের হতাশায় ফেলে।
ঙ. শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব
- ৬ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী থাকা সত্ত্বেওদের একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মের অভাব রয়েছে, যা তাদের অধিকারের জন্য কার্যকরভাবে দাবি জানাতে পারে।
- আমাদের অনৈক্যই আমাদেরকে অনেকাংশে পিছিয়ে রেখেছে।
- নিজেদের অনেক মুল্যবান ও জ্ঞানী ভাবাই অন্যদের কাছ থেকে নিজের দুরুত্বের সৃষ্টি করে।
২. শিক্ষকদের জিম্মি হওয়ার উদাহরণ
ক. আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা
- অধিকাংশ সময় শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে নামতে হয়।
- কোন অধিকারই সহজ ভাবে আদায় হয় না।
- অতিরিক্ত বৈষম্যের শিকার।
- এটি শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যাহত করে এবং শিক্ষকদের পেশাদারিত্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
খ. চাকরির অনিশ্চয়তা
- এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়, যা শিক্ষকদের মানসিক চাপ এবং পেশাগত অস্থিরতা তৈরি করে।
- সকল ক্ষেত্রেই কমিটি নামক অচলতন্ত্র এর মাধ্যমে শিক্ষকদের চাপে রাখা হয়।
গ. অবমাননাকর আচরণ
- অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যা তাদের পেশাগত মর্যাদাহানির কারণ হয়।
- অন্যান্য অনেক পেশাজীবিরাই এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের অবজ্ঞার চোখে দেখে।
৩. সম্ভাব্য সমাধান
ক. জাতীয়করণ
- এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জাতীয়করণ তাদের আর্থিক নিরাপত্তা, চাকরির স্থায়িত্ব, এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে।
- জাতীয়করণ শিক্ষকদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজে উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে।
খ. নীতিগত সংস্কার
- এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যাতে তাদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে।
- শিক্ষাব্যবস্থায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের গুরুত্ব এবং অবদানের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।
গ. আর্থিক সহায়তা ও বেতন কাঠামো উন্নয়ন
- সরকারি শিক্ষকদের মতো একই ধরনের বেতন কাঠামো এবং সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।
- কর্মচারীদের পেনশন এবং অন্যান্য সুবিধা চালু করা উচিত।
ঘ. শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ সংগঠন
- শিক্ষকদের জন্য একটি কার্যকর ও ঐক্যবদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা তাদের দাবি আদায়ে সংগঠিতভাবে কাজ করবে।
ঙ. প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি
- শিক্ষকদের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য একটি কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
- অভিযোগ বা সমস্যার জন্য একটি নির্দিষ্ট ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
৪. উপসংহার
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় অংশ, এবং তাদের অবস্থা উন্নয়ন না হলে শিক্ষাব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত করা সম্ভব নয়। তাদের জিম্মি হয়ে থাকার এই অবস্থা থেকে মুক্ত করতে সরকার, প্রশাসন এবং শিক্ষকদের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন এবং ন্যায্য দাবির প্রতি মনোযোগ দেওয়া হলে শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এবং দেশের শিক্ষা খাত আরও উন্নত হবে।