এমপিওভুক্ত (মান্থলি পে অর্ডার) শিক্ষকদের দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সমস্যা ও বঞ্চনা নিয়ে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাদের কর্মপরিস্থিতি ও সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমস্যাগুলো বিশদভাবে আলোচনা করা হলো—
১. বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতা
- কম বেতন: এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় অনেক কম। এই বেতনে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
- উৎসব ভাতা: সরকারি চাকরিজীবীরা বছরে দুইবার পূর্ণ উৎসব ভাতা পেলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা অর্ধেক উৎসব ভাতা পান।
- বোনাস ও অন্যান্য সুবিধা: সরকারি চাকরিজীবীদের মতো চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া, পরিবহন ভাতা প্রভৃতি কোনো সুযোগ-সুবিধা এই শিক্ষকদের নেই।
২. ইনক্রিমেন্ট ও পদোন্নতির জটিলতা
- নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি) পাওয়া নিয়েও অনেক জটিলতা থাকে। সময়মতো ইনক্রিমেন্ট না পাওয়ার কারণে শিক্ষকরা হতাশ হয়ে পড়েন।
- পদোন্নতির সুযোগ: বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে পদোন্নতি প্রায় নেই বললেই চলে। দীর্ঘদিন একই পদে থেকে কাজ করতে হয়, যা তাদের পেশাগত উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
৩. অবসর ও কল্যাণ সুবিধার অভাব
- অবসর ভাতা: এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসর ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো এই ভাতা প্রদান করা হয় না, যা অবসরকালীন সময়ে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে।
- কল্যাণ তহবিল: শিক্ষক কল্যাণ তহবিলের কার্যক্রম আরও গতিশীল এবং সমৃদ্ধ হওয়া উচিত, যাতে শিক্ষকরা তাদের প্রয়োজনের সময় আর্থিক সহায়তা পেতে পারেন।
৪. চাকরির নিরাপত্তাহীনতা
- এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সময় নিরাপত্তা থাকে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির কিছু সিদ্ধান্ত বা ব্যক্তিগত মতবিরোধের কারণে তাদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
৫. সামাজিক ও মানসিক চাপ
- সমাজের অবমূল্যায়ন: বেসরকারি শিক্ষকদের সমাজে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয় না। কম বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার অভাব তাদের পেশার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে।
- চাকরির চাপ: অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজের চাপ যেমন—প্রাইভেট টিউশন বন্ধে নীতিমালা বা নানা বিধিনিষেধ শিক্ষকদের আয় সীমিত করে ফেলেছে।
৬. শিক্ষার মান উন্নয়নে বাধা
বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা না থাকলে শিক্ষকদের মধ্যে পেশাদারিত্ব ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে শিক্ষাদানের মানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রস্তাবনা ও সমাধান
১. সরকারি শিক্ষকদের সমপরিমাণ বেতন ও ভাতা: এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন কাঠামোকে সরকারি শিক্ষকদের সমান করতে হবে।
২. উৎসব ভাতা ও অন্যান্য ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি: উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা চালু করা প্রয়োজন।
৩. নিয়মিত পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্ট ব্যবস্থা: বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এবং পদোন্নতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. অবসর ও কল্যাণ সুবিধার উন্নতি: অবসরকালীন ভাতা দ্রুত পরিশোধ এবং কল্যাণ তহবিল আরও শক্তিশালী করা দরকার।
৫. চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: চাকরি নিরাপত্তার জন্য একটি শক্তিশালী নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
৬. সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি: শিক্ষকদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সরকারকে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাতে হবে।
উপসংহার
শিক্ষকরা জাতি গঠনের কারিগর। তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা যদি দুর্বল থাকে, তাহলে শিক্ষার মান উন্নত করা সম্ভব নয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবি মেনে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উন্নয়ন সম্ভব হবে এবং শিক্ষকরা তাদের মর্যাদা ও সম্মান ফিরে পাবেন।
Post Views: 135
Leave a Reply