এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বৈষম্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে গেলে এটির আর্থিক, সামাজিক এবং পেশাগত বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করতে হয়। এই বিশ্লেষণে প্রধান বৈষম্যগুলো এবং তাদের সম্ভাব্য সমাধানের দিকগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. বেতন ও ভাতার বৈষম্য
- অবস্থা:
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন কাঠামো সরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় খুবই সীমিত।
- সরকারি চাকরিজীবীরা যে স্কেলে বেতন পান, তা এমপিওভুক্তদের ক্ষেত্রে অনেক কম।
- ভাতা (যেমন, চিকিৎসা ভাতা, হাউজ রেন্ট, উৎসব ভাতা) নিয়মিতভাবে দেওয়া হলেও এর পরিমাণ সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের তুলনায় নগণ্য।
- বেতন ভাতাদি যা পায় তা কোন নির্ধারিত সময়ে দেওয়া হয় না। কথন 5 তারিখ তো আবার কখনও 10 তারিখে প্রদান করা হয়।
- বেতনের বিষয়ে সকল সময় অবহেলার শিকার করা হয় হেয় করা হয়। বেতনকে অনুদান বলে তাচ্ছিল্য করা হয়।
- সমস্যা:
আর্থিক সীমাবদ্ধতা তাদের জীবনযাপনে প্রভাব ফেলে এবং পেশার প্রতি তাদের উৎসাহ কমায়। সাংসারিক ও সামাজিক চাপ বৃদ্ধি পায়।
- সমাধান:
সরকারকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। বেতন ভাতা পর্যায়ক্রমে সরকারি স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। সঠিক সময়ে ইচ্ছা করলেই বেতন ভাতাদি প্রদান করা সম্ভব।
২. পেনশন সুবিধার অভাব
- অবস্থা:
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য পেনশন বা অবসরকালীন কোনো আর্থিক সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই।
- অবসরকালীন সময়ে তারা আর্থিক সংকটে পড়েন, কারণ দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে তারা স্থায়ী কোনো আর্থিক সুবিধা পান না।
- অবসর ও কল্যানের সুবিধা নামক যে এককালীন টাকা তাদের দেওয়া হয় তাতেও নানা প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতি।
- সমস্যা:
এ অবস্থা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।
- সমাধান:
অবসরকালীন সঞ্চয় প্রকল্প বা পেনশন স্কিম চালু করা যেতে পারে। এছাড়া সরকার বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অবসরকালীন ভাতা নিশ্চিত করা উচিত। বিদ্যমান ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
৩. চাকরির নিশ্চয়তার অভাব
- অবস্থা:
এমপিওভুক্ত চাকরিগুলোর ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে চাকরি স্থায়িত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
- বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান এমপিও বাতিল হলে শিক্ষক-কর্মচারীরা চাকরি হারান।
- প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির চোখ রাঙানি দেখতে হয় সবসময়।
- সমস্যা:
চাকরির নিরাপত্তা না থাকায় শিক্ষকরা পেশার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন না। এতে শিক্ষার সঠিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
- সমাধান:
এমপিওভুক্ত চাকরিগুলোর নিশ্চয়তা দিতে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
৪. প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়ন
- অবস্থা:
সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা উন্নয়নমূলক সুযোগ-সুবিধা এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা পান না।
- পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি নেই।
- সমস্যা:
এই বৈষম্যের কারণে তারা শিক্ষার আধুনিক পদ্ধতি বা প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকেন।
- সমাধান:
- পেশাগত উন্নয়নের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা।
- ডিজিটাল শিক্ষণ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।
৫. ছুটির সুবিধায় বৈষম্য
- অবস্থা:
সরকারি চাকরিজীবীরা যে ধরনের ছুটি (যেমন মাতৃত্বকালীন, চিকিৎসা ছুটি) পান, তা এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সীমিতভাবে পান।
- সমস্যা:
ছুটি নিয়ে অনিয়ম ও বৈষম্যের কারণে তাদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং কাজের প্রতি মনোযোগ কমে।
- সমাধান:
সরকারি চাকরিজীবীদের মতো সমান ছুটির সুবিধা প্রদান করতে হবে।
৬. সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা
- অবস্থা:
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অনেক ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় কম মর্যাদা দেওয়া হয়।
- তাদের কাজের মানের ওপর এই পার্থক্য প্রভাব ফেলে।
- সামাজিকভাবে নিজেদের ছোট মনে হয়।
- অভিভাবকদের অবহেলার শিকার হতে হয়।
- সমস্যা:
শিক্ষকেরা তাদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে হতাশায় ভোগেন, যা শিক্ষার গুণগত মান কমিয়ে দেয়।
- সমাধান:
শিক্ষকদের সম্মানজনক মর্যাদা প্রদান নিশ্চিত করতে সচেতনতা এবং নীতি-নির্ধারণী পদক্ষেপ নিতে হবে।
৭. উন্নয়ন বাজেট থেকে বঞ্চনা
- অবস্থা:
এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত সরকারি বাজেট থেকে তেমন কোনো উন্নয়ন সুবিধা পায় না।
- ফলে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে সমস্যা দেখা দেয়।
- সমস্যা:
উন্নয়ন বাজেটের অভাবে শিক্ষার পরিবেশ ও গুণগত মান নষ্ট হয়।
- সমাধান:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত বাজেট নিশ্চিত করা উচিত।
৮. অতিরিক্ত কাজের চাপ
- অবস্থা:
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা অনেক সময় অতিরিক্ত কাজ করেন, কিন্তু তার জন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পান না।
- যেমন পরীক্ষার দায়িত্ব পালন বা প্রশাসনিক কাজ।
- সমস্যা:
এই অতিরিক্ত দায়িত্ব তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ভারসাম্য নষ্ট করে এবং পেশার প্রতি তাদের অসন্তোষ বাড়ায়।
- সমাধান:
অতিরিক্ত কাজের জন্য আলাদা ভাতা বা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব
- অবস্থা:
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি লক্ষ্য করা যায়।
- রাজনৈতিক বা স্থানীয় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কারণে প্রকৃত যোগ্য প্রার্থীরা নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হন।
- সমস্যা:
এর ফলে মেধাবীরা এই পেশায় আগ্রহ হারান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান নষ্ট হয়।
- সমাধান:
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও মেধার মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। একটি কেন্দ্রীয় নিয়োগ বোর্ড গঠন করা যেতে পারে।
১০. বেতন প্রদানে গড়িমসিঃ
- প্রতিমাস শেষে বেতন প্রদান গড়িমসি। আজ পর্যন্ত বেতন মাস শেষে একটি নিদিষ্ট নির্ধারিত তারিখে বেতন করার রীতি চালূ করতে পারে নি।
- সমস্যাঃ এর ফলে যা হয় শিক্ষকদের উপর সংসারিক চাপ তৈরি হয়। যার ফলে তার কর্মস্থলের প্রতি অনিচ্ছাকৃত অনীহা তৈরী হয়।
- সমাধানঃ এই সমস্যা সমাধানে কোন অতিরিক্ত অর্থ ও অতিরিক্ত শ্রম কিছুই লাগে না। যেটার প্রয়োজন তা হল ইচ্ছা শক্তি।
11. সকল ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অবহেলার শিকারঃ
- পৃথিবীতে মনে হয় এই পেশা একমাত্র পেশা যার কোন সঠিক মানদন্ড নেই। সকল চাকুরীর একটি চাকুরী বিধিমালা আছে যা এই পেশায় নেই। বলা হয় সরকারী শিক্ষকদের আদলে আমাদের পরিচালিত হতে হবে কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সেটাও মানা হয় না।
- আমরা যে পেশাজীবি সে কথাটা কেউ শিকারই করতে চায় না।
- সমস্যাঃ এর ফলে যা হচ্ছে তা হলো আমাদের প্রতিনিয়ত অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে।
- সমাধানঃ ইচ্ছা করলেই একটি সঠিক বিধিমালা তৈরী করা সম্ভব অথবা সরকারী শিক্ষকদের মতো করে চলতে হয় তাহলে সেটারই সঠিক বাস্তাবায়ন নিশ্চিত করা।
12. ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করাঃ
- আমাদেরকে সকল সময় আমাদের ন্যয্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
- উৎসবের ভাগ হয় নাকি। আজ প্রায় 20 বছর আগের প্রদেয় 25% উৎসব ভাতা যা আজও বহাল আছে।
- বাড়ি ভাড়া 1000/- টাকা। যা দিয়ে কুঁড়ে ঘর ভাড়াও পাওয়া যাবে না।
- চিকিৎসা ভাতা 500/- যার অর্থ দাড়াঁয় আমাদের কোন রোগ বালাই হয় না।
- সমস্যাঃ এই সকল সমস্যাগুলো পঞ্জীভুত হয়ে একদিন বড় ধরনের ক্ষোভে পরিণত হবে।
- সমাধানঃ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলেই এই সকল সমস্যাগুলো পর্যায়ক্রমে সমাধান করতে যা কিনা এই রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব।
13. মিথ্যা আশ্বাস প্রদানঃ
- বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্বে মিথ্যা আশ্বাস প্রদান করে থাকে। পরবর্তীতে সেটা ভুলে যান।
- সমস্যাঃ এর ফল যা হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি অবিশ্বাস এর জন্ম হয় যা থেকে রাজনৈতিক অসেচতনতার তৈরি হয়।
- সমাধানঃ আমাদের রাজনৈতিক দল গুলো ইচ্ছা করলেই তাদের গঠনমুলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ইচ্ছা করলেই এই সমস্যাগুলো দুর করতে।
14. নিজেদের আভ্যন্তরীন দ্বন্দঃ
- প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অন্যতম প্রধান সমস্যা হল প্রধান শিক্ষকদের সাথে সাধারণ শিক্ষকদের দুরুত্ব।
- প্রধান শিক্ষকদের আনুকুল্যে থাকা শিক্ষকদের ভাবগিরি দেখানো।
- প্রধান শিক্ষকদের ক্ষমতার বলয় তৈরী করা।
- সমস্যাঃ এর ফলে শিক্ষার সঠিক পরিবেশ তৈরী হচ্ছে না। যা কিনা আমাদের কাহারই কাম্য হওয়া উচিত নয়।
- সমাধানঃ সঠিক ও দক্ষ শিক্ষকদের প্রশাসনিক দ্বায়িত্ব প্রদান করা।
15. শিক্ষা অফিস গুলোর দাদাগিরিঃ
- আমাদের দেখভালের দ্বায়িত্বে থাকা সরকারী শিক্ষা অফিস গুলো প্রতিনিয়ত আমাদের উপর তাদের কতৃত্ব দেখাতে ব্যস্ত।
- সরকারী শিক্ষকদের কাছে অবহেলার স্বীকার হয়ে আমাদের কাঝে এসে তার ঝাল মেটায়।
- আর একটা বিড়ম্বনা অফিসার হল মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার যার কাজ হলো আমাদের বিভিন্ন সেবা মুলক কাজের দেখভাল করা তিনি সেটা না করে সবসময় সকল শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকদের সহায়তায় ভয়ভীতি দেখাতে ব্যস্তা।
- সমস্যাঃ শিক্ষকদের করণীয় কাজ গুলো সম্পর্কে তারা অসচেতন হয়ে পড়ছে।
- সমাধানঃ সঠিক ও যোগ্য লোকদের এই সকল দ্বায়িত্বে পাঠানো। এবং তার সঠিক কাজ তাকে বোঝানো।
উপসংহার
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বৈষম্য দূর করতে হলে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা, পেশাগত উন্নয়ন, এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের উচিত এ বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে তারা উন্নত মানের শিক্ষা প্রদান করতে পারেন এবং একই সঙ্গে তাদের জীবনের আর্থ-সামাজিক মান উন্নয়ন ঘটে।
Post Views: 73
Leave a Reply