প্রশাসনিক জটিলতা বলতে বোঝায় এমন সব কাঠামোগত বা প্রক্রিয়াগত বাধা, যা কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে ধীর, কঠিন বা জটিল করে তোলে। বাংলাদেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা একটি বড় সমস্যা, যা তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত হতে গেলে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি রাজনৈতিক প্রভাব বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেরি হয়।
বেসরকারি শিক্ষকদের কাজের মান এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দক্ষতা পর্যালোচনার জন্য কার্যকর কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিতে ব্যর্থ হয়।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। জেলা বা উপজেলা শিক্ষা অফিস এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বিল অনুমোদন প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং তদারকির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মীদের মধ্যে দক্ষতার অভাব বা উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। এটি শিক্ষকদের পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ডাটা ম্যানেজমেন্ট এবং অটোমেশন ব্যবস্থা নেই। ফলে কাজ ম্যানুয়ালি করতে হয়, যা সময় ও সম্পদের অপচয় ঘটায়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি বা শিক্ষকদের সুবিধা প্রদানে রাজনৈতিক প্রভাব বা পক্ষপাতমূলক আচরণ অনেক ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশাসনিক জটিলতা দূর করার জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে:
এমপিওভুক্তি, বেতন-ভাতা প্রদান এবং পর্যবেক্ষণের পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হলে সময় এবং জটিলতা কমবে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা একটি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে, যারা প্রক্রিয়া সহজতর এবং দ্রুত সম্পন্ন করবে।
প্রতিটি শিক্ষকের এবং প্রতিষ্ঠানের একটি স্বচ্ছ ডাটাবেজ তৈরি করে প্রশাসনিক তদারকি সহজ করা।
জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তাদের দক্ষতা বাড়ানো।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করে একটি শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
প্রশাসনিক জটিলতা শুধু শিক্ষকদের জীবনকে কঠিন করে তুলছে না, এটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক মান উন্নয়নেও বাধা সৃষ্টি করছে। কার্যকর নীতিমালা ও প্রশাসনিক সংস্কার করা গেলে শিক্ষকদের জন্য একটি স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি হবে, যা শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে নেতিবাচক বা অবমূল্যায়নমূলক। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাদের পেশাগত মর্যাদা, কাজের মূল্যায়ন এবং সামাজিক অবস্থানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এর কারণগুলো নিম্নরূপ:
সরকারি শিক্ষকরা বেশি বেতন, পেনশন, চিকিৎসা সুবিধাসহ অন্যান্য ভাতা পান, যা তাদের সমাজে বেশি সম্মানিত করে তোলে। অন্যদিকে, বেসরকারি শিক্ষকদের এই সুবিধাগুলো না থাকায় সমাজে তাদের গুরুত্ব কম বলে বিবেচিত হয়।
বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলক কম। সমাজে অর্থনৈতিক অবস্থানকে পেশার মানদণ্ড হিসেবে দেখা হয়। ফলে তারা আর্থিকভাবে দুর্বল থাকায় অনেক সময় তাদের পেশাকে তেমন সম্মান দেওয়া হয় না।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। এর ফলে শিক্ষকদের পেশাদারিত্বের চেয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালকের লাভ বেশি প্রাধান্য পায়। সমাজ এ বিষয়টি নেতিবাচকভাবে দেখে।
বেসরকারি শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষকদের মতো নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বা প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেন না। ফলে তাদের কাজকে সমাজে প্রয়োজনীয় কিন্তু সম্মানজনক পেশা হিসেবে গণ্য করা হয় না।
শিক্ষার প্রকৃত গুরুত্ব এবং শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক মানুষের পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। তারা মনে করেন, বেসরকারি শিক্ষকরা কেবল চাকরি করছেন, শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন না।
গ্রামাঞ্চলে বেসরকারি শিক্ষকদের সম্মান আরও কম। তারা সাধারণত অল্প বেতনে কাজ করেন এবং সামাজিকভাবে সরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকেন।
শিক্ষার মানোন্নয়নে বেসরকারি শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে গণমাধ্যম এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো।
বেসরকারি এবং সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন ও ভাতার পার্থক্য কমানো। সমান সুযোগ দিলে তাদের পেশাগত মর্যাদা বাড়বে।
শিক্ষাক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য বেসরকারি শিক্ষকদের পুরস্কার এবং সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া।
বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং পেশাগত স্বীকৃতি বাড়ে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের সম্মান নিশ্চিত করতে শিক্ষাকে শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার পরিবর্তে এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে দেখার ব্যবস্থা করা।
বেসরকারি শিক্ষকদের গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে তাদের গুরুত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র আর্থিক সুবিধা বা কাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষকদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব তৈরি করা। একমাত্র তখনই বেসরকারি শিক্ষকরা প্রকৃত অর্থে সমাজে মর্যাদা ও গুরুত্ব পাবেন।
Leave a Reply