ফিলিস্তিনের শান্তি ফিরে আসা নিয়ে অনেকেই আশাবাদী, তবে বাস্তবতা বেশ জটিল। দীর্ঘদিনের এই সংঘাতের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূখণ্ডের মালিকানা, জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদ, এবং রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘর্ষ। আন্তর্জাতিক চাপ, শান্তির উদ্যোগ এবং বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আলোচনা চললেও পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি।
ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন:
1. **বৈষম্য ও শোষণের অবসান:** **বৈষম্য ও শোষণের অবসান** ফিলিস্তিনের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এই দুই বিষয় মূলত সংঘাতের গভীরতা বাড়াচ্ছে এবং শান্তির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন আমরা বৈষম্য ও শোষণের কথা বলি, তখন আমরা মূলত নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে বুঝি:
**ভূখণ্ড ও সম্পদে বৈষম্য**
ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে ভূখণ্ডের মালিকানা, সম্পদ, এবং জায়গার ব্যবহার নিয়ে মারাত্মক বৈষম্য বিদ্যমান। ফিলিস্তিনের গাজা এবং পশ্চিম তীরের (West Bank) জনগণের জন্য কম সুযোগ এবং উন্নত জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সীমিত। এসব অঞ্চলে জল, কৃষি জমি, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অবকাঠামোগত সুবিধা ইসরায়েলি নাগরিকদের তুলনায় অনেক কম। ইসরায়েলি বসতিতে উন্নত প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিক্ষার সুযোগ থাকলেও ফিলিস্তিনিদের জন্য এসব কিছুই প্রাপ্তি সহজ নয়।
**আকস্মিক এবং দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণ**
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ, বোমাবর্ষণ এবং ঘর-বাড়ি ভাঙচুরের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছে। এসব আক্রমণ শুধু মানবিক বিপর্যয়ই সৃষ্টি করে না, বরং স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রাকে আরও সংকটময় করে তোলে। অনেক সময় এই আক্রমণের ফলে হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরছাড়া হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে।
**অপারেশনাল বৈষম্য**
ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি বাহিনী দ্বারা লাগানো বাধা, চেকপোস্ট এবং অবরোধের কারণে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নানা ধরনের প্রতিকূলতা সম্মুখীন হয়। গাজা উপত্যকা, যেখানে ২০০৭ সাল থেকে হোমল্যান্ড নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেখানে এক ধরনের অবরোধ সৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে সেখানে মৌলিক মানবিক সহায়তা, চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। পশ্চিম তীরেও চলমান অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতা এবং ইসরায়েলি সেটেলমেন্টের দ্রুত বৃদ্ধি এই বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
**রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার**
ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ ভূমিতে বসবাস করলেও তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রায়শই ক্ষুণ্ণ হয়। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি অঞ্চলে তাদের স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর স্বাধীনতা নেই, বিশেষ করে যারা ইসরায়েলি অধিকৃত অঞ্চলে বসবাস করেন। একদিকে ইসরায়েলের নাগরিকরা নির্বাচন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, এবং মত প্রকাশের অধিকার ভোগ করেন, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত।
**শোষণ ও দমন-পীড়ন**
শোষণ বলতে শুধু অর্থনৈতিক বা সামাজিক শোষণ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দমনও বোঝায়। ফিলিস্তিনিদের অনেক সময় তাদের সাংস্কৃতিক অধিকার, ভাষা এবং পরিচয়ের ব্যাপারে বাধা দেয়া হয়। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রকাশকে দমন করে, তাদের জীবনযাত্রায় নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং তাদের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করে।
—
**বৈষম্য ও শোষণের অবসান করার উপায়**
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এই বৈষম্য ও শোষণের অবসান অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য কিছু সম্ভাব্য পদক্ষেপ হতে পারে:
1. **স্থায়ী দুই-রাষ্ট্র সমাধান:** আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুটি রাষ্ট্রের ধারণা, যেখানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন একে অপরের অস্তিত্ব মেনে চলবে, এবং নিজেদের ভৌগলিক সীমানায় স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।
2. **অবরোধ শিথিল করা:** গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের ওপর থেকে অবরোধ উঠিয়ে দেয়া এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়া, যাতে তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও মানবিক সহায়তা প্রাপ্তি করতে পারে।
3. **আন্তর্জাতিক চাপ এবং সহায়তা:** জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব রাষ্ট্রগুলোকে ফিলিস্তিনের অধিকার রক্ষায় একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া শান্তির জন্য ইতিবাচক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও সমঝোতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
4. **মানবাধিকার রক্ষায় মনোযোগ:** ইসরায়েলি সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার যেমন নিরাপত্তা, চিকিৎসা, শিক্ষা, এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
5. **অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সংলাপ:** ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের মধ্যে অভ্যন্তরীণ একতা প্রয়োজন। ফিলিস্তিনের দুটি প্রধান রাজনৈতিক গোষ্ঠী—হামাস ও ফাতাহ—এর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা একটি সম্মিলিতভাবে শান্তির জন্য কাজ করতে পারে।
**সারাংশ:**
ফিলিস্তিনে বৈষম্য ও শোষণের অবসান হলে তা শান্তির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। তবে, এর জন্য সমঝোতা, ন্যায্যতা এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। শোষণ এবং বৈষম্য দূর না হলে, শুধু সাময়িক শান্তি নয়, বরং একটি স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়।
2. **ভূখণ্ডের ভাগাভাগি** ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাতের একটি মূল বিষয়, যার উপর শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অনেকাংশে নির্ভরশীল। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডের ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে, তবে এটি যে কতটা জটিল, তা বোঝা যায় ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি থেকে।
### ভূখণ্ডের ভাগাভাগির ইতিহাস
১. **ব্রিটিশ ম্যান্ডেট (1917–1948):**
ফিলিস্তিন অঞ্চলে প্রথম বড় ভূমিকার পরিবর্তন আসে যখন ব্রিটিশরা ১৯১৭ সালে **ব্যালফোর ডিক্লারেশন** এর মাধ্যমে প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নেয়। এর পরবর্তী সময়ে, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে প্যালেস্টাইনে ইহুদি এবং আরব জনগণের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ১৯৪৭ সালে **জাতিসংঘের ভাগাভাগি পরিকল্পনা** (UN Partition Plan) ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাব দেয়, যেখানে প্যালেস্টাইনের ৫৫% ভূখণ্ড ইহুদিদের জন্য এবং ৪৫% ভূখণ্ড আরবদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। তবে এই পরিকল্পনা আরব দেশগুলো দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়, এবং এর পরপরই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়, যা “নাকবা” বা ফিলিস্তিনিদের জন্য এক ধ্বংসাত্মক সময়ের সূচনা হয়।
২. **১৯৬৭ সালের যুদ্ধ (সিক্স-ডে ওয়ার):**
১৯৬৭ সালে, ইসরায়েল এবং তার আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে আরও একটি যুদ্ধ শুরু হয়, যা **সিক্স-ডে ওয়ার** নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে, ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেম, সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান হাইটস দখল করে। পশ্চিম তীর এবং গাজা বর্তমানে ফিলিস্তিনের প্রাদেশিক অঞ্চল হিসেবে গণ্য হলেও, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের দখলে রেখেছে এবং এখানে ইহুদি বসতি নির্মাণের কাজ চলছে।
### ভূখণ্ডের ভাগাভাগির প্রশ্ন
বর্তমানে, ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড সম্পর্কে নানা দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক উদ্যোগ রয়েছে, তবে প্রধানত দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা দেখা যায়:
#### ১. **দুই রাষ্ট্রের সমাধান (Two-State Solution)**
দুই রাষ্ট্রের সমাধান হলো সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা, যার উদ্দেশ্য হল **ইসরায়েল** ও **ফিলিস্তিন** দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একে অপরের পাশে থাকার সুযোগ পাবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী,
– **ইসরায়েল** তার বর্তমান সীমায় থাকবে (এটি ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমানা থেকে কিছুটা কম হতে পারে)।
– **ফিলিস্তিন** একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পশ্চিম তীর, গাজা এবং পূর্ব জেরুজালেমের একাংশ নিয়ে গঠিত হবে।
এই ধারণার ভিত্তিতে বিভিন্ন শান্তি আলোচনা, যেমন **অলিম্পিয়া চুক্তি** (Oslo Accords) এবং **আল-কুদস** (Jerusalem) সম্পর্কিত নানা আলোচনা হয়েছে, কিন্তু নানা রাজনৈতিক, ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা উদ্বেগ, এবং ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের কারণে এটি বাস্তবায়িত হয়নি।
#### ২. **এক রাষ্ট্র সমাধান (One-State Solution)**
এক রাষ্ট্র সমাধান হলো একটি রাষ্ট্রের মধ্যে সব নাগরিকদের সমান অধিকার দেওয়া, যেখানে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন একক রাষ্ট্রে যুক্ত হবে। তবে এটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্কিত, কারণ ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাধীনতা এবং আত্মনির্ভরতার সমস্যা উত্থাপন করে। ইসরায়েলি জনগণ এই সমাধানকে সাধারণত অগ্রাহ্য করে, কারণ তারা ভয় পায় যে এতে ইসরায়েলের **জাতিগত এবং ধর্মীয় পরিচিতি** ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
#### ৩. **ইসরায়েলি বসতি এবং পশ্চিম তীর**
এখনকার পরিস্থিতিতে, **পশ্চিম তীর** একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এখানে ইসরায়েলি বসতি গড়ে উঠেছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের প্রায় ৫০০,০০০ এর বেশি বসতি রয়েছে, এবং এই বসতিগুলো **আন্তর্জাতিক আইন** অনুযায়ী অবৈধ। ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে বসবাস করার অধিকার দাবি করে, তবে ইসরায়েলি বসতিগুলো এবং নিরাপত্তার জন্য নির্মিত দেয়াল এসব দাবি মোকাবিলা করে। এই বসতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার ভোগ করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
### ভূখণ্ডের ভাগাভাগির প্রধান চ্যালেঞ্জ
১. **জেরুজালেমের মর্যাদা**:
জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত। এটি ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর। ইসরায়েল পুরো শহরকে নিজেদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক অংশই পূর্ব জেরুজালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়।
2. **ইসরায়েলি বসতিগুলি**:
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি বৃদ্ধি এই ভূখণ্ডের ভাগাভাগির জন্য একটি বড় বাধা। বসতি গড়ে উঠতে থাকার ফলে, একটি ক্রমবর্ধমান ভূখণ্ডের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এই বসতিগুলো ইসরায়েলের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অংশ হয়ে উঠেছে, যা একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথে বড় প্রতিবন্ধকতা।
3. **শরণার্থী সমস্যা**:
১৯৪৮ সালের নাকবা বা “দুঃখের দিন” থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। তাদের অধিকাংশই ফিরতে চায়, তবে ইসরায়েল তাদের ফিরতে দিতে রাজি নয়, কারণ এটি ইসরায়েলের **জাতিগত পরিচয়** ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এই শরণার্থী সমস্যা, এবং তাদের অধিকার পুনঃস্থাপন, একটি বড় সমস্যা।
4. **নিরাপত্তা ব্যবস্থা**:
ইসরায়েল একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা চায়, যাতে সে নিশ্চিত হতে পারে যে, ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে যাবে না। আর ফিলিস্তিনিরাও নিজেদের নিরাপত্তা চায়, যাতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করে।
ভূখণ্ডের ভাগাভাগি কখনোই সহজ বিষয় ছিল না, এবং এটি সমাধান না হলে শান্তির জন্য সম্ভাবনা সীমিত। একদিকে, দুই রাষ্ট্রের সমাধান বা সীমানা সংক্রান্ত কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া না যায়, তবে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠা খুব কঠিন হবে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা, পক্ষগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং সমঝোতার প্রচেষ্টার মাধ্যমে কিছুটা অগ্রগতি হতে পারে।
3. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা** ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাতের সমাধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এই সংঘাতের প্রকৃতি এত জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদী যে, শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে একে সমাধান করা প্রায় অসম্ভব। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও চাপ ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে কেবল সমাধান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা হয় না, বরং সঠিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং মানবিক সহায়তা প্রদান করাও সম্ভব হয়।
### আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিভিন্ন দিক
#### ১. **জাতিসংঘের ভূমিকা (UN)**
জাতিসংঘ, বিশেষ করে **জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ** এবং **জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ**, ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাতের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে।
– **জাতিসংঘের প্রস্তাবনা:** জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে প্রথম ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড ভাগাভাগি করার একটি প্রস্তাব দেয় (UN Partition Plan), যার মাধ্যমে দুটি রাষ্ট্র—একটি ইহুদি এবং একটি আরব—গঠন করার কথা ছিল। যদিও এটি আরব দেশগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে পরবর্তীতে জাতিসংঘ বিভিন্ন সময় শান্তির প্রচেষ্টায় উদ্যোগ নিয়েছে।
– **নিরাপত্তা পরিষদ:** জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একাধিক রেজুলেশন (যেমন, রেজুলেশন ২৪২ এবং ৩৩৮) পাস করেছে, যা ইসরায়েলকে দখলকৃত অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং শান্তি আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে। যদিও ইসরায়েল এই রেজুলেশনগুলির বাস্তবায়ন মেনে চলেনি, কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য এই রেজুলেশনগুলির গুরুত্ব রয়েছে।
– **বিশ্ব স্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তা:** জাতিসংঘের **UNRWA** (United Nations Relief and Works Agency) ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদান করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আশ্রয় এবং খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
#### ২. **ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)**
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিলিস্তিন–ইসরায়েল শান্তি প্রক্রিয়ায় একটি সক্রিয় অংশীদার। EU এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা:
– **শান্তির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা:** EU আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে এবং শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে কাজ করে। বিশেষ করে, EU বিভিন্ন সময়ে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি আলোচনার সেতু হিসাবে কাজ করার চেষ্টা করেছে।
– **অর্থনৈতিক সহায়তা:** EU ফিলিস্তিন সরকারের জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি ইউরো সহায়তা প্রদান করে। এটি উন্নয়ন, অবকাঠামো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা দিয়ে থাকে।
– **ইসরায়েলি বসতি নির্মাণের বিরোধিতা:** EU, ইসরায়েলের পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে এবং ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে।
#### ৩. **আরব দেশগুলো এবং আরব লীগ**
আরব দেশগুলো এবং **আরব লীগ** ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য বহু বছর ধরে সমর্থন দিয়ে আসছে।
– **আরব লীগ:** আরব লীগ ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ২০০২ সালে **আরব শান্তি উদ্যোগ** (Arab Peace Initiative) প্রস্তাব করা হয়, যেখানে বলা হয় যে, আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করবে যদি ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের সীমানায় ফিরে যায় এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়।
– **আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সহায়তা:** অনেক আরব দেশ বিভিন্ন সময়ে শান্তি আলোচনায় নিজেদের কূটনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করেছে, এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করেছে।
#### ৪. **মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র**
**মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র** ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাতের অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তি। ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন সবসময় শক্তিশালী, তবে যুক্তরাষ্ট্র শান্তি প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:
– **শান্তি পরিকল্পনা:** যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে বিভিন্ন শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে, যেমন **ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি** (1978), **ওসলো চুক্তি** (1993), এবং ২০০০ সালের **ক্লিনটন প্যারামিটারস**। তবে, বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
– **নিরাপত্তা সহায়তা:** যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ব্যাপক নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান করে থাকে, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করেছে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি ন্যায়বিচারের অভাব হিসেবে দেখা হয়।
– **তিন রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতি সমর্থন:** মার্কিন সরকার দুই রাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে থেকেছে, তবে অনেক সময় ফিলিস্তিনিদের অধিকার এবং নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু সমালোচনা এবং বৈষম্য সৃষ্টির কারণে শান্তি প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে পড়েছে।
#### ৫. **বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (IMF)**
**বিশ্ব ব্যাংক** এবং **IMF** ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করে।
– **বিশ্ব ব্যাংক:** ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা, এবং নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করছে।
– **IMF:** IMF ফিলিস্তিনের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করে, তবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং সীমিত ভূখণ্ডের কারণে কার্যকর সমাধান কঠিন হয়ে পড়ে।
### আন্তর্জাতিক সহযোগিতার চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
1. **বৈষম্য এবং দ্বিচারিতা:** আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পক্ষের (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন) ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাতের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে একটি একমুখী সমাধান পাওয়া কঠিন।
2. **ইসরায়েলের অনমনীয়তা:** ইসরায়েল কিছু কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমাধান এবং চাপ উপেক্ষা করে নিজের অবস্থান অটুট রেখেছে, যেমন পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণের ক্ষেত্রে।
3. **ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি:** ফিলিস্তিনের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি, বিশেষ করে **হামাস** ও **ফাতাহ** গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ, আন্তর্জাতিক সহায়তার কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
### উপসংহার
ফিলিস্তিন–ইসরায়েল শান্তি প্রক্রিয়ায় **আন্তর্জাতিক সহযোগিতা** অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, যা সুষ্ঠু সমাধানে সহায়তা করতে পারে। তবে, এর সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে আন্তর্জাতিক সমাজের ঐক্য, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং শান্তিপূর্ণ সমঝোতার প্রক্রিয়া অনুসরণের উপর।
শান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে, তবে এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে ঐক্য, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার ওপর। সবদিক বিবেচনা করে, ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি দীর্ঘ, কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে, কিন্তু আশাবাদী থাকা জরুরি।
Leave a Reply