বাংলাদেশের বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা বৈষম্যমুলক হওয়ার পেছনে কিছু মূল কারণ রয়েছে। এদের মধ্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের তারতম্য, এবং শিক্ষার সুযোগের অভাব প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের জন্য ফি এবং অন্যান্য খরচ অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত উচ্চ। এর ফলে, উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে ভর্তি করতে পারলেও, দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের ভালো শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। একটি সাধারণ স্কুলের খরচও অনেক ক্ষেত্রে নিম্নআয়ের পরিবারদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। এতে সমাজে শিক্ষার অভাবে বৈষম্য আরও বাড়ে।
বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মানের খুব বড় তারতম্য রয়েছে। কিছু স্কুল অত্যন্ত উচ্চমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করে, যেখানে উন্নত শিক্ষা, ভালো শিক্ষক এবং আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু একইসাথে অনেক বেসরকারী স্কুলে মানহীন শিক্ষা প্রদান করা হয়। এসব স্কুলে প্রায়ই ভালো শিক্ষক, পাঠ্যক্রম, এবং পরিবেশের অভাব থাকে, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত সাফল্যে বাধা সৃষ্টি করে।
বেসরকারী স্কুলগুলোর মধ্যে অনেকের অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। যেমন, কিছু স্কুলে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, পানি, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, পঠন-পাঠন উপকরণ ইত্যাদি নেই। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা একটি উপযুক্ত পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারে না, ফলে তারা যথাযথ শিক্ষা পায় না।
বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকরা প্রায়ই কম বেতন ও অনিশ্চিত চাকরির পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেন। এতে করে শিক্ষকরা কম মনোযোগী হন এবং তাদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নেও বাধা থাকে। অনেক সময় স্কুলগুলোর জন্য ভালো, প্রশিক্ষিত শিক্ষক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়, ফলে শিক্ষার মান কমে যায়।
বাংলাদেশে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায়। অনেক সময়, বেসরকারী স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট অর্জন করতে পারে না, কারণ তাদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা সাধারণত পর্যাপ্ত মানের নয়। এতে তারা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
বেসরকারী স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ সময় প্রাইভেট কোচিং বা অন্য অতিরিক্ত সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। এতে দেখা যায় যে, কেবলমাত্র যে পরিবারগুলো অতিরিক্ত খরচের সামর্থ্য রাখে, তারাই ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারে। অন্যদিকে, নিম্নআয়ের শিক্ষার্থীরা এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে এবং তাদের ফলাফল খারাপ হয়।
বাংলাদেশে বেসরকারী স্কুলগুলোর উপর সরকারের তদারকি যথেষ্ট কম। এ কারণে, অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান শিক্ষার মান উন্নত করতে বা বৈষম্য দূর করতে যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। ফলে, এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয় এবং বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক হলেও, একে শুধুমাত্র নেতিবাচক হিসেবে দেখলে হবে না। কিন্তু এই বৈষম্য দূরীকরণ এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হলে সরকারের পাশাপাশি, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আরও উন্নত পঠনপাঠন ব্যবস্থা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, এবং সবার জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা দিতে পারলে, বাংলাদেশের বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে।
Leave a Reply