বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চালিকাশক্তি হলেন শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-সম্পৃক্ত কর্মচারীরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে নানা আর্থিক সংকট ও অবহেলার শিকার হয়ে আসছেন। বিশেষ করে চিকিৎসা, বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা ও শিক্ষা ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে আছে।
সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে তুলনা করলে এমপিওভুক্তদের ভাতা কাঠামোতে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। যেমন:
এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, পেশাগত মর্যাদাও ক্ষুণ্ন করে।
প্রতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ সীমিত থাকে, যা মূলত অবকাঠামো, পাঠ্যপুস্তক ও পরিচালনা ব্যয়ে ব্যয় হয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের ভাতা বৃদ্ধির জন্য আলাদা তহবিল বরাদ্দ না থাকায় এটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎসব ভাতা ও অন্যান্য ভাতা বর্তমান বাজেট থেকে বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হলেও অর্থের ঘাটতির কারণে নাকচ হয়ে ফিরে এসেছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের বর্তমানে প্রাপ্ত সবগুলো ভাতা দ্বিগুন করতে প্রয়োজন ১১০০ কোটি টাকা যা বর্তমান বাজেট থেকে সংকুলান করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বর্তমানে শুধু মাত্র হয়তবা উৎসব ভাতা শিক্ষকদের ২৫% বৃদ্ধি করে ৫০% করা হতে পারে। কর্মচারীদের উৎসব ভাতা সম্ভবত পূর্বের ন্যায় ৫০% রয়ে যাবে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো এমপিওভুক্তদেরও শিক্ষাখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, কিন্তু নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এখনও তারা অগ্রাধিকারে আসেননি। এদেশের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে যারা রয়েছেন তারা মনে করে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা খুব একটা জরুরি নয়। ফলে বিভিন্ন ভাতা বৃদ্ধি সং।ক্রান্ত দাবিগুলো বারবার উপেক্ষিত হয়।
যথাযথ তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ ছাড়াই অনেক সময় বাজেট বা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাহিদা, ভাতা কাঠামোর প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা নিরুপণ করা কঠিন হয়।
শিক্ষক সংগঠনগুলো প্রায়ই বিভক্ত, যা দাবি আদায়ের আন্দোলনে দুর্বলতা তৈরি করে। ঐক্যবদ্ধ চাপ প্রয়োগ না থাকায় নীতিনির্ধারকেরা সহজেই বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারেন।
প্রতিটি ভাতা (বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, উৎসব, ও অন্যান্য ভাতা) বাড়ানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা বাজেট লাইন নির্ধারণ করতে হবে। এর মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব।
একটি স্বাধীন, নীতিনির্ধারক শিক্ষা কমিশনের আওতায় এমপিওভুক্তদের জন্য একটি সমন্বিত ভাতা কাঠামো তৈরি করতে হবে, যা সরকারি কর্মচারীদের সমতুল্য হবে।
শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এমপিওভুক্তদের ভাতা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা বা হোয়াইট পেপার তৈরি করা যেতে পারে। এটি সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।
বিভক্ত সংগঠনগুলোকে একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্মে এনে যুগপৎ দাবি ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুললে নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবেন।
পরিশেষ যে কথা বলতে চাই তাহলো আমরা সকলেই মানি শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, আর শিক্ষক হচ্ছেন সেই মেরুদণ্ডের রূপকার। অথচ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা এখনও ন্যায্য ভাতা থেকে বঞ্চিত। এটি শুধু আর্থিক বৈষম্য নয়, জাতীয় উন্নয়নের পথে এক অন্তরায়ও বটে। এখন সময় এসেছে বাস্তবভিত্তিক, সম্মানজনক এবং নীতিসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার। সরকারের সদিচ্ছা, প্রশাসনের কর্মদক্ষতা এবং শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারে।
Leave a Reply