“ভাসুর” ও “শ্বশুর”—বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবহেলার প্রতীক
“এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা আমলাদের ভাসুর আর সরকারের শ্বশুর”—এই তীব্র অভিব্যক্তিটি নিছক রসিকতা নয়, বরং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বঞ্চনার বাস্তব প্রতিফলন। এটি একটি সামাজিক হতাশা, রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা এবং শিক্ষকদের মর্যাদাহানির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
১. এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাস্তবতা
বাংলাদেশে হাজার হাজার শিক্ষক রয়েছেন যারা এমপিওভুক্ত হলেও সরকারি শিক্ষক হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা পান না। তারা বছরের পর বছর কাজ করেও থাকেন পদোন্নতি ও ন্যায্য বেতন-বৈষম্যের শিকার। সরকারি সহায়তা পেতে হয় আন্দোলন করে, অথচ সম্মানের জায়গায় তারা সবসময় উপেক্ষিত।
- বেতন ও সুযোগ-বঞ্চনা: সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় কম বেতন ও সীমিত সুযোগ-সুবিধা।
- পদোন্নতির অভাব: দীর্ঘ সময় একই পদে থেকে কর্ম-উন্নতির পথে স্থবিরতা।
- সম্মানহানির অভিজ্ঞতা: অনেক সময় শিক্ষকরা শুধুই “কর্মচারী” হিসেবে দেখা পান, চিন্তাশীল ব্যক্তি বা সমাজের বিবেক হিসেবে নয়।
২. “ভাসুর” ও “শ্বশুর” প্রতীকের অন্তর্নিহিত ব্যঙ্গার্থ
বাংলা সমাজে “ভাসুর” এবং “শ্বশুর” সম্পর্ক দুটি স্বীকৃত হলেও জটিল ও দ্বিমুখী মানসিকতার প্রতীক।
- ভাসুর: বাইরের দৃষ্টিতে সম্মানিত হলেও, সম্পর্কটি অনেকটাই লোকদেখানো। সমাজে ভাসুরকে নাম না নেওয়ার রীতি, মুখ আড়াল করে থাকা—সবই প্রতীকীভাবে এমপিও শিক্ষকদের সেই অবস্থান বোঝায়, যাদের সবাই সম্মান দেখায়, কিন্তু বাস্তবে অবজ্ঞা করে। আমলারা যতই মুখে শ্রদ্ধা দেখাক, প্রকৃতপক্ষে তাঁদের সমস্যা সমাধানে গড়িমসি করে থাকেন।
- শ্বশুর: মুখে বলা হয় “বাবার মতো”, বাস্তবে তার প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে না। সরকারও এমপিও শিক্ষকদের ঠিক এমন ভাবেই দেখে—মিডিয়ায় প্রশংসা করে, ‘জাতির বিবেক’ আখ্যা দেয়; কিন্তু ন্যায্য দাবিতে কান না দিয়ে, বরং ‘জামাই সুলভ’ মুখোশ পরে থাকে।
৩. আন্দোলন ও প্রতিক্রিয়া
বছরের পর বছর এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা রাজপথে আন্দোলন করে আসছেন—বেতন বৃদ্ধির দাবি, পদোন্নতির নিশ্চয়তা, এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধার দাবি নিয়ে। কিছু সময় সরকার আশ্বাস দেয়, কিছু সময় পুরোপুরি উদাসীন থাকে।
- সরকার বহু প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তব প্রয়োগে ধীরগতি।
- আমলাতন্ত্রে শিক্ষকদের দাবি প্রাধান্য পায় না—মাঝে মাঝে আন্দোলন ছাড়া তাদের উপস্থিতিও চোখে পড়ে না।
৪. করণীয় ও সমাধান
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কিছু কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন:
- বেতন বৈষম্য দূরীকরণ: সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য কমানো।
- পদোন্নতির স্পষ্ট নীতি: নির্ধারিত সময় পরপর পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করা।
- আমলাতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজন: শিক্ষকদের সঙ্গে আমলাদের সম্পর্ক হবে সহযোগিতামূলক, দাতাসুলভ নয়।
- শিক্ষকদের ঐক্য: একক আন্দোলনের বদলে সংগঠিত, ধারাবাহিক ও কৌশলগত আন্দোলন দরকার।
৫. উপসংহার
“ভাসুর” ও “শ্বশুর” প্রতীকের মাধ্যমে যেভাবে বেসরকারি শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে, তা শুধু কৌতুক নয়—একটি নির্মম বাস্তবতা। যে জাতি শিক্ষককে সম্মান দিতে ব্যর্থ, সে জাতি উন্নত হতে পারে না। সরকার ও প্রশাসনের উচিত মুখে প্রশংসা নয়, কাজে সম্মান দেখানো।
শিক্ষককে শুধু জাতীয় দিবসে নয়—প্রতিদিনের রাষ্ট্রীয় নীতিতে মর্যাদা দিতে হবে। তবেই তারা জাতির সত্যিকারের বিবেক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবেন।
Post Views: 187
Leave a Reply