আমাদের ক্রিকেট ও টেষ্ট ক্রিকেট

পৃথিবীতে টেষ্ট ক্রিকেট দ্বিপাক্ষিক সিরিজ চালু হয় ইংরেজী 15-18মার্চ 1877ইং সাল হতে। অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড এর মধ্যে। আমাদের টেষ্ট ক্রিকেটে পথচলা 2000সাল থেকে। দেখতে দেখতে কিন্তু 20-21বছর হতে চলল। সময়ের তুলনায় টেষ্ট ক্রিকেটে আমরা আমাদের পথচলা নিবিঘ্ন করতে পারিনি সেটা কি আমাদের দুর্বলতা নাকি আমাদের ব্যর্থতা সেটা একটা বিতর্কের বিষয়।

আমাদের কি প্রতিভার অভাব আমার মনে হয় না বা আপনারও বলবেন প্রতিভার অভাব খুব একটা নাই আমাদের আমাদের যেটা হয় প্রতিভার লালন করা আমরা শিখিনি এটা একটা বিষয়। আরও কিছু বিষয় আছে যে আমরা সবকিছু মধ্যে আমাদের রাজনীতি নিয়ে আসি। এখন হয়তো ভাববেন কই ক্রিকেটের মধ্যে আবার রাজনীতি কোথায় একটু ভাল করে খেয়াল করে দেখুন রাজনীতির প্রভাব আছে কিনা আপনি নিজেও টের পাবেন।

এর পরে যে বিষয়টা খেয়াল করার মতো তা হলো- ক্রিকেটে একটা প্রবাদ চালূ আছে যে, “টেষ্ট ক্রিকেট ইজ দ্য বেষ্ট ক্রিকেট” কিন্তু সেই বেষ্ট ক্রিকেট খেলতে হলে যে পরিমাণ প্রস্তুতি নিয়ে হয় তা কি আমরা কোন দিন নিতে পেরেছি। প্রস্তুতি বলতে আমি বলছি যে, দেখেন টেষ্ট ক্রিকেট 5 দিনের খেলা সেখানে 15টা সেশন খেলতে হয়, প্রতিপক্ষের 20টা উইকেট নিতে হয়, সেখানে প্রথম দিনে পিচ আর 5ম দিনের পিচের গতি প্রকৃতি এক রকম থাকেনা, সেখানে বোলারদের অনেক কিছু করা থাকে, সেখানে ব্যটসম্যানের টেম্পাম্যান্ট ও ক্লাস বোঝাতে হয়, সেখানে 20/30বল খেলে 40-50 রান করলাম আর আমার দ্বায়িত্ব শেষ হয়ে গেল এমন নয়। সেখানে 5দিন 15 সেশন খেলার মতো প্লেয়ারদের শারীরিক ফিটনেস একটা বিষয় থাকে। সবকিছু মিলিয়ে যে কথা গুলো বললাম তা নিয়ে হয় প্রস্তুতি সেই প্রস্তুতি নেওয়ার মতো পরিপূর্ণ সুবিধা কি আমরা আমাদের প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের দিতে পেরেছি। আমাদের দেশে এখনো আমরা রিজিওনাল ক্রিকেট চালু করতে পারিনি না করতে দেই নি। এখন হয়ত বলবেন এটা আবার কি ধরনের কথা যে আমরা আমাদের রিজিওনাল ক্রিকেট ইচ্ছাকৃতভাবে চালু করিনি। হ্যাঁ এটাই সত্যি যে আমরা আমাদের রিজিওনাল ক্রিকেট ইচ্ছাকৃত চালু করছি না। না করার পিছনে যে বিষয়টা কাজ করছে তা হল আমাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা। একটা দেশের প্রত্যেক অঞ্চলের ক্রিকেট খেলা আপনি ঢাকায় বসে নিয়ন্ত্রণ করবেন কিভাবে। আপনি কি দেশের প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষের চালচলন, তাদের চলাফেরা সমন্ধে বোঝেন যদি নাই বোঝেন তাহলে নিয়ন্ত্রন করলে সেই নিয়ন্ত্রণ কিভাবে ভাল কিছু হবে।

একটা দেশের টেষ্ট ক্রিকেটে ভাল করতে হলে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হল সেই দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা। সেই দেশের ফাস্টক্লাশ ক্রিকেটের উন্নয়ন করা। কিন্তু আমাদের ফাস্টক্লাশ ক্রিকেট আজ 20-22 বছরে কতটুকু উন্নতি করতে পেরেছি। আজও আমাদের দেশের ফাস্টক্লাশ ক্রিকেট খেলাটাকে পিকনিক ট্যুর হিসাবে খেলে ক্রিকেটাররা। সেখানে না আছে প্রতিযোগিতার ছোয়া না আছে সিরিয়াসনেস। টেবিলে বসে টিম তৈরী করে দেওয়া হলো আর পরের দিন মেশিনের মতো কয়েকজন খেলোয়াড় মাঠে বল আর ব্যাট হাতে নেমে গেল খেলতে। এটা কি কোন প্রতিযোগীতামুলক ক্রিকেটে চলে। চলে শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটে। আমাদের দেশের ফাস্টক্লাস ক্রিকেটের দল তৈরী হয় মাঠে বসে নয়। ঢাকায় বসে বিসিবির খেয়াল খুশি মতো। একটা ডিভিশনের দল তৈরী হবে সেখানে সেই ডিভিশনের প্লেয়ারদের চেনা জানা একটা জরুরী বিষয়। সেই ডিভিশনের কৃষ্টি কালাচার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না।

আমরা রিজিওনাল ক্রিকেট কাঠামো গড়ে তুলছি না তার একমাত্র কারণ হলো ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণ হয়ে যাবে তার ভয়ে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা আমাদের পুরাতন সমস্যা। কিন্তু রিজিওনাল ক্রিকেট কালচার যদি ডেভলপ করে তাহলে লাভ কিন্তু আমাদের ক্রিকেটের এবং রিজিওনাল ক্রিকেট ব্যবস্থা যদি গড়ে না ওঠে তাহলে আপনি লিখে রাখেন আমাদের ফাস্টক্লাশ ক্রিকেটের কাঠামো কখনই ভালভাবে আমাদের দেশে গড়ে উঠবে না। ফাস্টক্লাশ ক্রিকেটের উন্নতি না হলে আমাদের টেষ্ট ক্রিকেট এর উন্নতি কখনও হবে না। আপনি যদি আপনার সন্তানকে নিজে নিজে হাঁটতে না শেখান তাহলে কখনও সে নিজে নিজে হাঁটবে না। আর নিজে যদি হাঁটার চেষ্টা  না করে তাহলে কখনও সে স্বাবলম্বী হবে না। এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে আপনি আপনার সন্তানকে স্বাবলম্বি হিসাবে দেখতে চান কি না।

এখন কিছু আশার কথা বলি তা হলো আমারা বীরের জাতি। যুদ্ধ করে আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছি আমাদের দেশকে কেউ দানের বিনিময়ে আমাদের হাতে তুলে দেয়নি। তাই আমরা জানি আমরা এত সহজে হার মানব না। আমরা এত সহজে হারতে শিখিনি। আমাদের দেশে ক্রিকেট যে ভাবে চলে যেভাবে আমরা উন্নতি করছি এর সাথে যদি সঠিক পরিকল্পনা এবং সঠিক সাপোর্ট যদি পেত তাহলে আমদের টেষ্ট ক্রিকেট আজ কোথায় থাকত ভাবতে পারেন। হ্যাঁ বলতে পারেন যে একদিনেই তো আর অস্টেলিয়ার মতো বা ভারতের মতো সুযোগ সুবিধা বা অবকাঠামো আমরা তৈরী করতে পারবো না। কিন্তু সেরকম কিছু করার চেষ্টা করে তো আমরা দেখতে পারি। সেই চেষ্টা আমরা কতটুকু করেছি সেটা বলেন দেখি।

আমরা স্টেডিয়াম স্টেডিয়াম করে মাথা ঠুকছি এত এত স্টেডিয়াম কি আমাদের দরকার আছে ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য বেশি বেশি স্টেডিয়ামের দরকার নাই দরকার হলো বেশি বেশি খেলার মাঠ। খেলার মাঠ ও স্টেডিয়ামের মধ্যে অনেক পার্থক্য। বলবেন দুটোই তো একই জিনিস পার্থক্য কি পার্থক্য হলো এই একটা স্টেডিয়াম রক্ষণাবেক্ষণ করা যত ব্যয় সাপেক্ষ সেই তুলনায় একটা খেলার মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ করা অতটা কঠিন নয়। আমাদের মতো দেশের জন্য যে কাজটা করা উচিত বলে আমি এবং অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাই মনে করে তা হলো খেলার উপযোগী মাঠের সংখ্যা বাড়ানো স্টেডিয়ামের সংখ্যা বেশি বাড়ানো দরকার নাই একটা দেশে অত্যাধুনিক মানে 4-5টা স্টেডিয়াম থাকলেই হয়। কিন্তু খেলার মাঠ কিন্তু প্রতি উপজেলায় থাকাটা জরুরী কারণ খেলার মাঠ না থাকলে খেলা হবে না নিয়মিত এবং খেলা নিয়মিত না হলে কি আর ক্রিকেটের উন্নতি হয়।

আমাদের খেলোয়াড়দের এবং সংগঠকদের মধ্যে পেশাদারিত্ব আনতে হবে, সিরিয়াসনেস আনতে হবে। থাকতে হবে খেলার প্রতি মমত্ববোধ এবং সবকিছুতে 100% দেওয়ার উগ্রতা।

পৃথিবী বদলে যাচ্ছে এবং তার সাথে প্রতিনিয়ত সকল কিছুতেই পরিবর্তন হয়েছে। সেই অর্থে কিন্তু টেষ্ট ক্রিকেটেরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এখন কথা হলো আমরা আমাদেরকে কতটুকু পরিবর্তন করতে পেরেছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে প্রতিস্থাপন করাটা কিন্তু টিকে থাকার অন্যতম প্রধান শর্ত। আপনাকে উন্নতি করতে হলে আপনার ভিতরে দ্রুত অভিযোজন ক্ষমতা তৈরী করতে হবে।

আমাদের টেষ্ট ক্রিকেটের যে উন্নতি হয় তা কিন্তু নয় উন্নতি আমাদের ও হয়েছে কিন্তু যে মানের উন্নতি হয়েছে সে উন্নতি দিয়ে আমাদের সামগ্রিক ক্রিকেটের কতটুকু উন্নতি হয়েছে সেটা কিন্তু প্রশ্ন সাপেক্ষ। শুধু ঘরের মাঠে আমরা বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু ম্যাচ ভাল খেললাম আর দু একটা ম্যাচ জিতলাম তাহলে কি আমাদের উন্নতি হয়ে গেল তা কি আসল ব্যাপার। দরকার যুতসই উন্নতি। তার জন্য দরকার হলো ভালো মানের সুদরপ্রসারী পরিকল্পনা। শর্টটাইম পরিকল্পনা করে হয়ত ক্ষণিকের জন্য কিছু ফলাফল পাওয়া যেতে পারে যা দিয়ে ক্ষনিকের জন্য হয়ত দর্শকদের বাহাবা পাওয়া যাবে কিন্তু তা কখনই ভবিষ্যতের জন্য ভাল ফল বয়ে আনবে না।

পরিশেষে বলতে চাই যে, ক্রিকেট আমাদের গ্রাম্য খেলা না হলে ও এখন কিন্তু আস্তে আস্তে তা আমাদের গ্রামগঞ্জের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিচ্ছে। কারণ কিছুটা হলে ও এই খেলায় আমরা ভাল কিছু উৎসবের মুহূর্ত আমরা মাঝে মাঝে পাচ্ছি। তাই আপনাদের সবার কাছে বলতে যারা আপনারা এই খেলার সাথে জড়িত যারা এই খেলার গতি পথ নিয়ন্তণ করেন তাদের কাছে একটাই  চাওয়া তা হলো ক্রিকেট আমাদের বিশ্বমঞ্চে যে পরিচিতি এনে দিয়েছে তা আমরা ধরে রাখতে পারি।