বাংলাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে শুধুমাত্র পাঠদানের ভারটাই বহন করছেন না, বরং নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইটাও চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তাঁদের সংগঠনগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, এরা যেন শিক্ষকদের অধিকার রক্ষার সৈনিক নয়, বরং নিজেদের আখের গোছানোর মোড়ল!
বাংলাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নামে রয়েছে ৬২টিরও বেশি সংগঠন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই সংগঠনগুলোর বড় অংশই নাম সর্বস্ব। এদের কোনও বাস্তব ভূমিকা নেই। অধিকাংশ নেতারাই পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ — কেউ কারও উন্নতি দেখতে পারে না, বরং পরনিন্দা ও কুৎসা রটনাই যেন নিত্যকার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষকদের স্বার্থরক্ষার বদলে বেশিরভাগ সংগঠন ব্যস্ত থাকে সরকারের তোষামোদ আর রাজনৈতিক দলের পদলেহন করতে। মিছিল-মিটিংয়ের নাম করে নিজেদের ছবি তোলা আর সামাজিক মাধ্যমে বাহবা কুড়ানো যেন তাঁদের প্রধান কাজ। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলো প্রায়শই এইসব নেতাদের অবহেলার কারণে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
অনেক সংগঠন এমনও আছে যারা শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির পক্ষে নয় — বরং উল্টো কর্তৃপক্ষকে বলে, “ওদের দাবি মেনে নেবেন না, আমরা ম্যানেজ করে ফেলবো।” কতটা নিষ্ঠুর হতে পারলে একজন শিক্ষক নেতা হয়ে এমন কথা বলা সম্ভব?
১. সংগঠনের বিশৃঙ্খলা ও বিভক্তি:
এক ছাতার নিচে সবাই আসতে না পারা শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। প্রত্যেকে নিজেকে বড় নেতা মনে করে, কিন্তু ঐক্যের কোনও চিহ্ন নেই।
২. নেতৃত্বের অভাব ও স্বার্থপরতা:
বেশিরভাগ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শিক্ষকদের প্রকৃত সমস্যা নিয়ে রাস্তায় নামার সাহস দেখান না। বরং ব্যক্তিগত সুবিধা ও পদমর্যাদার মোহে ডুবে থাকেন।
৩. অপপ্রচার ও কুৎসা:
সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরে শিক্ষক-শিক্ষকের প্রতি বিশ্বাসের জায়গাটা আজ চরম সংকটময়। নিজের সহকর্মীর উন্নতি দেখলে অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে।
৪. সরকারের উদাসীনতা:
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত না হওয়া, নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না করা, অবসরভাতা ও কল্যাণ তহবিলের অর্থ বিলম্বে প্রদান ইত্যাদি সমস্যার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও অত্যন্ত উদাসীন।
প্রতি মাসের শেষে একই চিত্র: শিক্ষকরা টেনশনে থাকেন, “এইবারও বেতন সময়মতো পাব তো?”
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বারবার আশ্বাস দেয়, বারবার কথা দেয় — “পরের মাস থেকে ঠিক হবে।”
কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয় না। প্রতি মাসের বেতন প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও একই প্রতিশ্রুতি, একই ভাঙা রেকর্ড।
মাউশির ইএমআইএস সেল এখনও কার্যক্রমই শুরু করতে পারেনি, অথচ ছুটি-ছুটি করে অফিস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার দেরি, আবার ১০-১৫ তারিখের পরে বেতন! অথচ শিক্ষকেরও তো জীবন আছে, সংসার আছে, ঋণ আছে, দায়িত্ব আছে। সেদিকে কারও খেয়াল নেই।
সমাধান একটাই —
✅ প্রকৃত শিক্ষানুরাগী নেতৃত্ব গড়ে তোলা
✅ সমস্ত এমপিওভুক্ত সংগঠনের একীভূত মঞ্চ তৈরি
✅ শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও একতা প্রতিষ্ঠা
✅ দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ নেতৃত্বের বিকাশ
✅ সরকারের প্রতি সংগঠিত এবং শক্তিশালী দাবি পেশ করা
এখন সময় এসেছে — শুধু চুপচাপ দেখে যাওয়া নয়। যদি নিজের সম্মান বাঁচাতে হয়, শিক্ষক সমাজকে এখনই জেগে উঠতে হবে।
Leave a Reply