আমাদের ক্রিকেট ও ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট

প্রতি চার বছর পর পর ফুটবলের মতো ক্রিকেটও বিশ্বকাপ আয়োজন হয় আর ও খোলাসা করে বললে ওয়ানডে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আয়োজন হয়। কিন্তু বিশ্বকাপ খেলার জন্য যে নিয়ম এক এক বার একেক রকম তা কিন্তু সাধারণ দর্শকের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তারা সকল সময় ভাবে এবার আবার কোন নিয়মে দেশুগলো বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। এই সকল প্রশ্নের জন্ম দেয় সকল সময়। তবে সেই সমস্যা নিরসনে আইসিসিও বসে নেই তারা তাদের মতো করে কাজ করে চলেছে। তার ফলশ্রুতিতে এবার থেকে একটি ভিন্নধর্মী আয়োজন দেখা যাচ্ছে দলগুলো বাছাইয়ের ক্ষেত্রে।

এই বছর থেকে শুরু হয়েছে ওয়ানডে সুপার লীগ। এই সুপার লীগ চালু হওয়ার কারণ ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন। ওয়ানডে সুপার লীগে অংশ গ্রহণ করছে মোট 13টি দল। অনেকটা ফূটবল বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের মত। তবে ফুটবল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ফিফার উদ্দেশ্য থাকে মহাদেশ ভিত্তিক দল গুলো বাছাই হয়ে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করুক। আর ক্রিকেটের বেলায় আইসিসির উদ্দেশ্য তাদের পছন্দের দল গুলো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করুক এবং সেই ভাবেই তারা তাদের বাছাই পর্বের ফরম্যাট ঠিক করে। ফিফা যেখানে ফূটবলকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে অনগ্রসর দেশ গুলোকে কিভাবে আরও বেশি উৎসাহিত করা যায় সেই লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। আর আইসিসি ক্রিকেটে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবার নাম করে ক্রিকেটাকে আরও বেশি বেশি নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের খেলায় পরিণত করতে যাচ্ছে। আইসিসি এখন অবধি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করবার জন্য আজ অবধি নির্দিষ্ট কোন ফরম্যাট চালূ করতে পারে নি এটা তাদের অন্যতম প্রধান ব্যর্থতা। তবে এবারের ওয়াল্ড সুপার লীগের আয়োজনের যে ফরম্যাট আইসিসি চালূ করেছে তা কিন্তু আমার মতে এ যাবৎ দল গুলো বাছাই করার জন্য যে সমস্ত পদ্ধতিগুলো চালু ছিল তার মধ্যে কিন্তু বেষ্ট।এখানে থাকছে না দেশ গুলোর পূর্বের কোন রেটিং পয়েন্ট, প্রতিটি দল শুর করবে 0 পয়েন্ট থেকে। বাছাই পর্ব হবে 3টি লীগের মাধ্যমে 1) সুপার লীগ, লীগ 2, চ্যালেঞ্জ লীগ। সুপার লীগ অনুষ্ঠিত হবে 13টি দলের মধ্যে দল গুলো হল বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, উইন্ডিজ, সাউথ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড। প্রতিটি দল 24টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে। 13টি দলের টপ 8টি দল (স্বাগতিক সহ) বিশ্বকাপের মুল পর্বে সরাসরি  জায়গা করে নিবে। আর বাকি 5টি দল বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে সরাসরি অংশ নিবে। লীগ 2 এ থাকছে 7টি দল। বর্তমান ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লীগের স্ট্রাকচার অনুযায়ী14-20 নম্বর দলগুলো। এই লীগ দলগুলো 36টি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে। 7টি দলের মধ্যে টপ 3টি দল বাছাই পর্বে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। লীগ 2 অংশগ্রহণকারী শেষের 4টি দল প্লে অফে অংশ নিবে। চ্যালেঞ্জ লীগে অংশগহণকারী দেশের সংখ্যা 12(21-32নম্বর দলগুলো)। এই লীগ কে দুই ভাগে ভাগ করা হবে,লীগ এ এবং লীগ বি, যেকানে 2লীগের চ্যাম্পিয়ন বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্লে অফে অংশ নিবে। তাহলে প্লে অফে অংশ নিবে লীগ 2 এর শেষে 4দল এবং চ্যালেঞ্জ লীগের সেরা 2দল এই মোট 6দল। এর মধ্যে সেরা 2 দল বাছাই পর্ব খেলার সুযোগ পাবে। বাছাই পর্ব খেলবে সুপার লীগের নীচের 5দল লীগ 2এর শীর্ষ 3দল এবং প্লে অফের 2দল এই মোট 10দল এর মধ্যে থেকে মুল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবে 2টি দল।

এখন এখানে যে বিষয় ‍গুলো উল্লেখ করার মতো তা হলো দল গুলোর খেলার সংখ্যা বাড়বে ঠিক আছে কিন্তু তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ কতটুকু বাড়বে। তারা এভাবে সুযোগ পেলে কতদিনে মুলধারায় ফিরতে পারবে বা আদৌ তারা কি কোন দিন পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারবে। কারণ মুল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবে তো সেই 10টি দেশই। এভাবে যদি খেলতে থাকে তাহলে তাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ দিনে দিনে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে একবারের জন্য কি আইসিসি ভেবে দেখেছে। এভাবে কি ক্রিকেটের আদৌ কোন প্রকার উন্নতি হচ্ছে। এভাবে কি ক্রিকেট কোনদিন বিশ্বায়নের দিকে এগুবে বলে মনে হয়। এভাবে চললে ভাল দল গুলো আরও শক্তিশালী হবে আর দুর্বল দল গুলো হয়তবা আরও দুর্বল হবে। এভাবে যেটা যেটা হচ্ছে তা হলো মুষ্টিমেয় কিছু  দেশ বানিজ্যিক ভাবে লাভবান হবে। সাথে হয়ত আইসিসিও আর্থিক ভাবে কিছুটা লাভবান হবে কিন্তু আইসিসির এই বাণিজ্যিক নীতি কতদিন টিকে থাকবে। এটা কিন্তু প্রশ্ন সাপেক্ষে।

আইসিসির ঘোষণা অনুযায়ী স্বাগতিক দেশ অটোম্যাটিক চয়েজ তাহলে তাদের এই লীগে অংশগ্রহণের দরকার কি? বরং তারা অংশগ্রহণের ফলে জটিলতা আরও বাড়বে কমবে না। আইসিসি এখানেও স্বাগতিক দেশের আর্থিক বিষয়ের কথা ভেবে তাদের ও এই লীগে অংশগ্রহণের সুযোগ রেখেছে। এছাড়া অন্য কোন কারণ আছে বলে মনে হয় না। আইসিসির ‍এই দ্বিমুখী নীতির কারণে ক্রিকেটের কোন লাভ হবে কিনা জানিনা। আর এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে কিন্তু একদিন দর্শক এই খেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।

ভাল দলগুলো প্রথমে ভাল দলের সাথে প্রতিযোগীতা করবে এবং সেখান থেকে যে দল ‍গুলো ছিটক পরবে তারা কিন্তু অনেক শক্তিশালী হয়েই ছিটকে পড়বে যার ফলে তাদের লাভ হবে এই তারা যখন নিচের লেভেলের দলগুলোর সাথে মোকাবেলা করবে তাদের প্রস্তুতি আর নীচের দলগুলোর প্রস্তুতি কিন্তু রাত আর দিকে ফারাক থাকবে। এভাবে কি নতুন কোন দেশের উঠে আসার সুযোগ থাকবে। নতুন দেশ গুলো বড়জোড় বাছাইপর্ব এই তাদের গন্তব্য। কারণ যুদ্ধ জয়ের জন্য দরকার ভাল রকমের প্রস্তুতি ভাল রকমের প্রস্তুতি ছাড়া কঠিক প্রতিপক্ষের সাথে কখনই যুদ্ধ জয় করা সম্ভব নয়। সেই প্রস্তুতির সুযোগ কি নিচের সারির দলগুলো কখনই পায় বা তাদের দেয়া হয়।

আইসিসি হয়ত বলবে ক্রিকেটের পরাশক্তি গুলোর ক্রিকেট ঐতিহ্য আর নিচের সারির দলগুলোর ক্রিকেট ঐতিহ্য কি একরকম। তাদের ঐতিহ্যের কারণে তারা আজ এই জায়গায় পৌছেছে অতএব তাদের সুযোগ একটু বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আইসিসি অভিভাবক হিসাবে উচিত সবাইকে মোটামুটি একলেভেলের সুযোগ নিশ্চিত করা।

তবে এই নিয়মের কিছু ভাল দিক যে নেই তা কিন্তু নয় আগে যেমন টেষ্ট প্লেয়িং ন্যশন গুলো সরাসরি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের সুযোগ পেত যেখানে নতুন দেশ গুলোর সুযোগ আরও কম ছিল। তার চেয়ে কিন্তু বর্তমানের সিস্টেম অনেক ভাল কারণ এখানে অন্তত বাদ পড়ার শংকা সকলেরেই থাকছে কারণ এখন কিন্তু আর টেষ্ট প্লেয়িং ন্যশনগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ আর থাকছে না। সবাইকে একটা প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়েই আসতে হবে। যা সুপার লীগের অন্যতম ভাল দিক। তাই পারেফরমেন্স সকলেরই ভাল করার একটা তাগাদা থাকবে আর এই নিয়মের কিছু যদি ঘষামাজা করা যায় তাহলে এই নিয়ম কে আরও বেশি  ফলপ্রসু করা যাবে নিঃসন্দেহে।

এখানে আমাদের সম্ভাবনা আমি একবারে কম করে দেখছি না। আমাদের সম্ভাবনা সরাসরি সুপার লীগ থেকে আমরা অর্জন করতে পারি সেই সক্ষমতা আমাদের আছে। আর সেখানে যদি আমরা নাও পারি তবে পরবর্তীতে বাছাইপর্ব থেকে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে যাব হয়তবা। তবে আমি আবারও বলছি নতুন দলের উঠে আসার সম্ভাবনা অনেক কঠিন। আর তাই উচিত এমন কোন ফলপ্রসু সিস্টেম চালু করা প্রতিবারই যেন প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সাথে কমপক্ষে অন্তত 2টি করে নতুন কোন দেশের আসার সুযোগ থাকে। তাহলে দিন শেষে ক্রিকেটেরই জয়গান হবে এবং ক্রিকেট খূব দ্রুত গতিতে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।

পরিশেষে বলতে চাই এই নিয়মে আমাদের ক্রিকেট যে একেবারে চ্যালেঞ্জ এর মুখে পড়বে না তা কিন্তু নয়। তাই আমাদের উচিত হবে সঠিক পরিকল্পনা সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়া। কারও একক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে না গিয়ে সামষ্টিক পরিকল্পনা করে সেটা বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়া।